ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সড়কের শোভাবর্ধনে তালগাছ

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

 সড়কের শোভাবর্ধনে তালগাছ

তালগাছ এক পায় দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে। হ্যাঁ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তালগাছ’ কবিতার তালগাছের সারি সারি মনোরম দৃশ্য এখন আর মাঠে কিংবা রাস্তার ধারে তেমন চোখে না পড়লেও কিছু কিছু বৃক্ষপ্রেমিক এখনও স্মৃতি কিংবা ঐতিহ্য ধরে রাখতে এসব গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন। তেমনি একজন উপজেলার ফুলসারা ইউনিয়নের হাউলি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজেল হোসেন। যিনি ব্যক্তি উদ্যোগে আশির দশকে মালিগাতি মন্দির থেকে দুড়িয়ালি গ্রামের সংযোগ রাস্তা পর্যন্ত রাস্তার ধারে কয়েক শ’ তালগাছ লাগিয়েছিলেন। যা আজ দৃশ্যমান শোভাবর্ধন করছে। আজ সেই তালগাছগুলো বর্তমান ৫০ থেকে ৬০ ফুট লম্বা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, একদিকে এই তালগাছ ছায়াদানসহ প্রকৃতিতে যেমন অবদান রাখছে, অন্যদিকে গাছের ফল খেয়ে মানুষ উপকার ও তৃপ্তিবোধসহ সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করছে। অনেক বৃক্ষপ্রেমিক ও ভ্রমণপিয়াসী দৃষ্টিনন্দন এই তালগাছ এক নজর দেখতে আসছেন। পরিবেশের পরম বন্ধু তালগাছ রক্ষায় তালগাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মনজেল হোসেন বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির ক্ষয়রোধ, অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে তালগাছ রোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি আরও জানান, প্রতিবছর দুই একটা করে তালগাছের আঁটি নিজের জমিতে কিংবা রাস্তার ধারে রোপণ করে থাকেন। মনজেল হোসেনের দাবি তার লাগানো তালগাছের সারি জেলার সবচেয়ে বড় তালগাছের সারি। তালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Borassus flabellifer ইংরেজীতে বলে Plam tree. এটি এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন গাছ। এরা এরিকাসিস পরিবারের বরাসুসগণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। তালগাছ আমাদের দেশে যে কোন জায়াগায় যে কোন পরিবেশে অতি সহজে বেড়ে উঠতে পারে। জল ও খরা সহনীয় বলে বিল এলাকায় নিচু-উঁচু উভয় জায়গাতে তালগাছ হয়। অযত্নে আর আবহেলায় বেড়ে ওঠা এ তালগাছ রোপণে লোকজন এক সময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তালগাছের উপকারিতা সম্পর্কে জানার ফলে অনেকে তালগাছ রোপণ করতে এগিয়ে আসছে। অনেককে রাস্তার ধারে কিংবা জমির আইলে সারি করে তালের বিচি (আঁটি) রোপণ করতে দেখা যাচ্ছে। এক সময় শিক্ষা জীবনে প্রবেশের প্রথম, পিতা-মাতা তালগাছের পাতা সংগ্রহ করে এনে অ আ ক খ লিখে সন্তানের হাতেখড়ি দিত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে রৌদ্রের দুপুরে প্রচন্ড গরমে গাছের ছায়ায় বসে তালের রস পানের স্বাদ ও শান্তির ক্লান্তি দূর করার যেমন কোন জুড়ি নেই, তেমনি দুপুরে কাজের শেষে স্ত্রীর হাতের তাল পাখার ঠান্ডা বাতাসেরও জুড়ি নেই। যদিও বৈদ্যুতিক পাখায় সে জায়গাটা এখন দখল করে নিয়েছে। তালের রস, তালের গুড়, তালের কচি শাঁশ, আঁটির ফোবল (ফোঁপড়া), পাকা তালের পিঠা, বড়া খুবই সুস্বাদু খাদ্য। তাছাড়া তালপাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটায়, আঁকার পট, লেখার পুুঁথি, কুন্ডলি, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি হয়। তালের কান্ড দিয়ে বাড়ি, নৌকা ও হাউস বোট তৈরি হয়। চৌগাছা সরকারী কলেজের জীব বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক (অব.) আবুল কাশেম জানান, খাদ্যগুণের মধ্যে তালের ফল ও বিচি দুইই বাঙালী খাদ্য। তালের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলরি, তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড় পাটালি, মিছরির মতো সুস্বাদু খাদ্য তৈরি হয়। তালে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাসিয়াম আয়রন ও ক্যালসিয়াম, লৌহ, আঁশ ও ক্যালরিসহ আরও অনেক খনিজ উপাদান রযেছে। এছাড়াও রয়েছে এ্যান্টি অক্সিজেন ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। উপজেলা কৃষি অফিসার রইচ উদ্দীন জানান, দেশে তালগাছ কমে যাওয়ায় বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। এই গাছ উঁচু হওয়ায় বজ্রপাতা নিজে গ্রহণ করে মানুষসহ প্রাণীদেরও রক্ষা করে থাকে। বর্তমান তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় দেশে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এজন্য সুপরিকল্পিতভাবে সরকারী এবং বেসরকারীভাবে বেশি বেশি তালগাছ লাগাতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। -সাজেদ রহমান, যশোর থেকে
×