ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিবসেনা

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

 মুজিবসেনা

রিহান রাস্তা পার হওয়ার জন্য ডানে-বামে তাকানোর সময়েই ঘটনাটা ঘটল। একদম চোখের নিমিষেই ঘটে যাওয়া ঘটনাটা রিহানকে আহত করল, কিন্তু স্তব্ধ নয়। সে দৌড়ে রাস্তার মাঝখানটায় চলে গেল, যেখানে বয়স্ক মানুষটা গাড়ির ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছেন। রিহানের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়েছে জায়গাটায়। রিহান মানুষটাকে ধরে বসিয়ে বলল, আপনি ঠিক আছেন কাকা? বয়স্ক মানুষটার সেদিকে হুঁশ নেই। তিনি হাতে ধরা পতাকাগুলোকে তাড়াতাড়ি উঁচু করে ধরলেন। পতাকা ঝুলিয়ে রাখা বাঁশের লাঠিটার গায়ে কয়েকবার চুমু খেয়ে বললেন, ইশ! আমার পতাকাগুলো মাটিতে পড়ে গেল! মানুষটা একজন পতাকাওয়ালা। এখন ডিসেম্বর মাস চলছে। এই সময়টায় পতাকা বিক্রেতা দেখা যায় খুব। সে রকমই একজন। রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিলেন বয়স্ক মানুষটা। সঙ্গে হাতের পতাকাগুলোও রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। মানুষটার একটাই হাত। অন্য হাতের জায়গায় শুধু ঘামে ভেজা শার্টের হাতাটা। বাঁ হাতটা নেই তাঁর। রিহান খুব অবাক হয়ে দেখল, নিজে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন- সেটা নিয়ে বৃদ্ধর কোন মাথা ব্যথাই নেই। পতাকা থেকে ধুলো পরিষ্কার করতে ব্যস্ত তিনি। রিহান অবশ্য সেটা নিয়ে কিছু বলল না। সে বলল, কাকা, আপনার হাত ছিলে গেছে। আমি আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই চলুন। বৃদ্ধ বললেন, না না। আমি বাড়ি যাব। হাতের এটা নিয়ে চিন্তা কর না। রিহান একটু ভেবে বলল, ক্ষতটা অল্পই আছে। ঠিক আছে, আপনাকে বাড়ি দিয়ে আসি চলুন। আপনার বাসা কোথায়? বয়স্ক মানুষটা একটু হেসে বললেন, না না, আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। এই তো, পাঁচ মিনিট হাঁটলেই ওইদিকের বস্তিতে আমি থাকি। রিহান অবশ্য শুনতে চাইল না। একটা রিকশা ডেকে নিল মানুষটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। রিকশায় বসে বৃদ্ধ বললেন, এত বছরে কোনদিন পতাকায় ধুলো লাগতে দিইনি। আজকে লেগে গেল! রিহান বলল, এটা দুর্ঘটনা ছিল কাকা। আপনি নিজেকে দায়ী করবেন না। কথা বলতে বলতেই তারা বস্তিতে চলে এল। বস্তির সরু গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রিহানকে নিয়ে বৃদ্ধ তাঁর ঘরে চলে এলেন। এক হাতেই পতাকাগুলো খুব যতœ করে লাঠি থেকে খুলতে খুলতে রিহানকে বললেন, তুমি ভেতরে এসে একটু বসো না। রিহান ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর। নিচু টিনের চাল। ঘরের একপাশে একটা ভাঙ্গা চৌকি, আরেক পাশে একটা নড়বড়ে টেবিল। আসবাব বলতে এই দুটোই। পুরো ঘরে ময়লা কাপড়চোপর, কিছু বাসন-কসন- সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ রিহানের চোখে পড়ল, ঘরের টিনের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি বড় করে বাঁধাই করে টাঙ্গানো। সে খুব অবাক হলো। এই বস্তিতে যেখানে একটা মানুষ থাকতে-খেতে পারে না ঠিক মতো, সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি? সে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, কাকা, আপনার ঘরে বঙ্গবন্ধুর ছবি? বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন সেদিকে। বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে আন হাত কপালে ঠেকিয়ে স্যালুট দিলেন। তারপর বললেন, তুমি শুনবা সেই গল্প? রিহান জিজ্ঞেস করল, কোন্ গল্প? আমি শুনব কাকা। বৃদ্ধ বললেন, ১৯৭১ সাল। দ্যাশ তখন উত্তাল। আমাগো তখন অল্প বয়স। রক্ত গরম। সেই সময় মার্চ মাসে শেখ সাহেব সকলের ডাক দিল। যুদ্ধের ডাক। যার যা আছে তাই লইয়া যুদ্ধ করতে কইল। শেখ সাহেব আছিল আমার আদর্শ। তার জন্য জান দিতেও দুইবার ভাবতাম না। শেখ সাহেবের মতো নেতা তো পূর্ব পাকিস্তানে আর ছিল না। আমরা তো মনে কর পাকিস্তানী গো অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তখন শেখ সাহেব কইল, আমরা স্বাধীন হইতে পারুম। স্বপ্ন দেখায় দিল। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়া এক কাপড়ে ঘর ছাড়লাম। ইন্ডিয় গেলাম ট্রেনিং নিতে। রিহান চোখ কপালে তুলে বলল, আপনি মুক্তিযোদ্ধা! বৃদ্ধ হেসে বললেন, হ! আমি মুক্তিযোদ্ধা। বাঁ-হাত দেখিয়ে বললেন, দুইটা গুলি লাগছিল। হাতটা রাখা যায় নাই। কাইটা ফালাইতে হইছে। কিন্তু ওগোরে তো ছাড়ি নাই। ওগোরে জখম কইরা শ্যাষ কইরা ছাড়ছি। তারপর আবার বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মানুষটারে কি ভুলতে পারি বাজান? উনার জন্যই তো ঘর ছাড়ছি, যুদ্ধ করছি, বাংলাদেশ পাইছি। পরতে কদিন উনারে স্যালুট দেই বাজান। উনি আমার ঘরে না থাকলে জীবনডা অসম্পূর্ণ লাগে। রিহান আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনি মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে আপনি এখানে এভাবে কেন থাকেন? বৃদ্ধ আবার হাসলেন। বললেন, ভাগ্য, বাজান, ভাগ্য। এই ভাগ্য নিয়া আফসোস নাই আমার। আমার দ্যাশ স্বাধীন হইছে, আমি তাতেই খুশি। আমি এই যুদ্ধ, এই স্বাধীনতা, এই দ্যাশরে বুকে নিয়াই মরতে চাই। এইজন্যই তো আমি সারাডা বছর পতাকা বিক্রি করি বাজান। আমার মনে হয়, আমার কাজডা সবচেয়ে সম্মানের কাজ। নিজের দ্যাশের পতাকা, রক্ত দিয়ে কেনা পতাকা উঁচু কইরা ধরার কাজ! আমি এই নিয়াই খুশি বাজান। আর কিছু আমার লাগব না। রিহান অপলক দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্যালুট করল। বলল, মুজিবসেনা আপনি। এই দেশ গড়ার যোদ্ধা আপনি। স্যালুট তো আপনিও পান, কাকা! ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ দ্বাদশ শ্রেণী (ইংলিশ ভার্সন) অলঙ্কণ : প্রসূন হালদার
×