ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প॥ শাস্তি

প্রকাশিত: ০৮:১১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

গল্প॥ শাস্তি

মতলবের চায়ের দোকানে বেশ কিছুদিন পর আসা। কি করে আসবে? আগের বাকি টাকাগুলো আজ দেবে কাল দেবে করে করে দু’মাস পার করে দিয়েছে। দু’মাস ধরে কথা দেওয়ার পরও বকেয়া পরিশোধ না করায় তার কোনোকিছু এসে যায়নি- এমনটিই ভাবনা তার। অন্য যে কেউ হলে টাকাগুলো হাতে নিয়ে তবেই মতলেবের সামনে দাঁড়াত। কিন্তু নিজামউদ্দিনের সে উপায় কি আর আছে? বিড়ির নেশাটা যেভাবে তাকে চেপে ধরেছে, তাতে মতলেবের দোকানে না গিয়ে তার আর রক্ষা নেই। দিনে যার কয়েক প্যাকেট বিড়ি না খেলে প্রশান্তি আসে না, তার পেটে দু’দিন ধরে একটি বিড়িও যায়নি- ভাবাই যায় না। পাশের বাড়ির ফরমান আর আশাদের কাছে বিড়ি চাওয়ার মাত্রাটা এতই প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ‘না রে ভাই, আর বিড়ি দিতি পারব না নে। মাংনা মাংনা আর কত?’ এতে যে নিজামউদ্দিনকে যথেষ্ট অপমান করা হয়েছে সেকথা তার আর বুঝতে বাকি থাকল না। ‘পদমর্যাদার দিক দিয়ে ওরা কি খুব উপরে?’-এরকম কথা মতলেব বললেও কি নিজামউদ্দিন মানতো? ফরমান ও আশার কথায় নিজামউদ্দিনের ভিতর দারুণভাবে ক্ষত সৃষ্টি হলো। ‘না-হ, শালাদের কাছে আর কুনুদিন বিড়ি চাতি যাব না।’- ক্ষোভের কথাগুলো নিজেকেই শোনাল সে। মতলেব সবেমাত্র দোকানের ঝাঁপি তুলে বসেছে। দূর থেকে বিষয়টি লক্ষ্য করল নিজামউদ্দিন। দু’একজন ক্রেতা নগদ টাকায় কিছু জিনিস কিনল- এটাও তার দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ল না। সাত-সকালে বাকিতে বিড়ি কিনতে গেলে খুব একটা ভালো যে দেখায় না তা তার ভালো করেই জানা আছে। তাছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শুভযাত্রার ব্যাপার-স্যাপার যে থাকে সে ব্যাপারেও তার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে বলে তার বিশ্বাস। দূর থেকে একজন ক্রেতাকে নগদ টাকায় জিনিস কিনতে দেখে তার চোখেমুখে আশার আলো ফুটে উঠল। ছোটবেলার খেলার সঙ্গী মতলেব বকেয়া পরিশোধ না করার দায়ে নিশ্চয় একটি বিড়ি থেকে তাকে বঞ্চিত করবে না- সে বিশ্বাস নিজামউদ্দিনের আছে। তাছাড়া, মতলেবের যখন দোকান ছিল না, তখন নিজামউদ্দিনের কাছ থেকে কত বিড়ি খেয়েছে সে, তার হিসাব কি মতলেবের জানা আছে? এসব ভেবে বিড়ি পাওয়ার আশার মাত্রাটা আরও একটু বেড়ে গেল। টাকা পরিশোধ করার কথা একেবারেই ভুলে গেল নিজামউদ্দিন। ভাবনার জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এতক্ষণে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল নিজামউদ্দিন। দোকানের সামনে বাঁশের চরাটে অনেকেই বসে আড়মোড়া ভাঙছে। একরকম নিশ্চুপই চরাটের ওপর এসে বসল। একজন ক্রেতার সঙ্গে লেনদেন চলার সময়ই আড়চোখে নিজামউদ্দিনকে এক ঝলক দেখে নিল দোকানদার মতলেব। বকেয়া পরিশোধ না করার দায়টুকু একগাল হাসিতে ম্লান হওয়ার সম্ভাবনা যে একেবারেই কম, তা জানা সত্ত্বেও অকৃত্রিম এক চিলতে হাসিমুখে মতলেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল আগন্তুক নিজামউদ্দিন। এতক্ষণেও দোকানদারের দৃষ্টি আকর্ষণ না করতে পেরে মুখ খুলল সে, ‘মতলেব একটা বিড়ি দে দিন! আজ দু’দিন...।’ কথা শেষ না করেই তাকে থামতে হলো। গ্রামের অন্য সবার মতো সেও নিজামউদ্দিনকে নিজু বলেই ডাকে। ‘দেখ নিজু, আগের অনেকগুলো টাকা তোমার কাছে পাওয়া যাবে। দিবা করে করে দিচ্চো না। বন্দু মানুষ বুলে কিছু বুলতি পাচ্চিনে। অন্য কেউ হলি নোকজনের সামনেই কলার ধরে টাকা আদায় করে নিতাম।’ - কথাগুলো শোনার পর স্তব্ধ হয়ে গেল নিজামউদ্দিন। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তা যেন এই মুহূর্তের জন্য তার ভাষা কেড়ে নিলেন। চলার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে গেল। পা দুটি যেন মাটির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। মতলেবের কথাগুলো বারবার তার কানে বাজছে। ‘কী বুললো মতলেব! এই কি বন্দুর নমুনা?’- কথাগুলো ভাবতে গিয়েও যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। কতদিন যে কথাটা মনে থাকবে তা একমাত্র নিজামউদ্দিন ছাড়া আর কেউ জানে না। অনড় নিজামউদ্দিন এতক্ষণে স্বাভাবিক হলো। অনেক কষ্টে ‘আচ্চা’ শব্দটি মুখ থেকে বের করে দ্রুত দোকান থেকে চলে এলো। রাগে অপমানে ক্ষুব্ধ নিজামউদ্দিন বাড়ি আসতে না আসতেই তার বউ জরিনা বেগম বলে বসল, ‘আর ইট্টু পরে সমিতির স্যার কিস্তি নিতি আসপে। আগের কিস্তি এ্যাকবার দ্যাওনি! আজগে যে করেই হোক সমিতির টাকা কিন্তুক দিতি হবে, আগেততে বুলে রাকলাম।’ কথাগুলো জরিনা বেগমের স্বামীর রাগের মাত্রা যে বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো তা কথা শেষ না হতেই বোঝা গেল। অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে বউকে বেধড়ক পেটাতে আরম্ভ করল। মারের শব্দ শোনামাত্র এদিক-সেদিক থেকে অনেকেই ছুটে আসলো। ‘কী দোষ বউডার!’- বলতে বলতে ওদিক থেকে ছুটে আসলো মালেকা বেগম। নিজামউদ্দিনের হাতের লাঠিটি কেড়ে নিল পাশের বাড়ির হেকমত। সুবাদে বড় ভাবী হওয়ায় মালেকা বেগমকে সব সময় সম্মানের চোখে দেখে নিজামউদ্দিন। আর সে জন্যই মালেকা বেগমের আগমনে ক্ষান্ত হলো সে। মালেকা বেগমের অনুপস্থিতিতে আরও কিছু লাঠির বাড়ি জরিনা বেগমের পিঠে যে পড়তÑ এতে কোনো ভুল ছিল না। অবলা জরিনা বেগমরা সব সময়ই নিজামউদ্দিনদের নির্যাতনের শিকার। নিজামউদ্দিনরা নিজেদের ব্যর্থতাকে দমিয়ে রাখতে জরিনাদের মতো পোষমানা-গৃহপালিত নারীদেরকে সব সময় হাতের মুঠোয় রেখে সেই মুঠো হাত ব্যবহার করে ওদেরই পিঠে। মুঠো হাতের সঙ্গে মন মতো তৈরি করা বাঁশের লাঠিও ব্যবহৃত হয়। সবকিছু হজম করার জন্যই যেন জরিনারা পৃথিবীতে এসেছে! নিজামউদ্দিনের নির্যাতনের শিকার জরিনা বেগমের কাছে নতুন কোন বিষয় নয়। এরকম মার প্রায়ই হজম করতে হয় নিজামউদ্দিনের বউকে। কতবার নিজামউদ্দিনের সংসার ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে চেয়েছে, কিন্তু বাবা মরা জরিনা বেগম দুখিনী মা আর ছোট ভাইটার কথা ভেবে যেতে পারেনি। অভাবী মায়ের সংসারে নতুন করে বোঝা হতে চায়নি সে। সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই এনজিও কর্মী চলে এসেছেন। কুসুম আরার বাড়িতে কিস্তি তোলা হয়। সবার কিস্তি জমা হলেও জরিনা বেগমের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। জরিনা বেগমকে না পেয়ে নিরূপায় এনজিও কর্মী কুসুম আরাকে সঙ্গে নিয়ে নিজামউদ্দিনের বাড়িতে হাজির হলেন। কালবৈশাখী তার প্রলয় নৃত্য দেখিয়ে পরক্ষণেই যখন শান্ত প্রকৃতি উপহার দেয়, মনেই হয় না একটু আগে সে তার ধ্বংসলীলা দেখিয়েছে, ঠিক তেমনি শান্ত প্রকৃতির মতো নিজামউদ্দিন ঘরের মধ্যে চৌকির উপর ডানদিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এই মানুষটি একটু আগে তার স্ত্রীকে ইচ্ছেমতো প্রহার করেছে। এনজিও কর্মীকে দেখামাত্র জরিনা বেগম সালাম দিলো। ‘স্যার বসেন।’ - ভারি গলার কণ্ঠস্বর। ‘না, বসবো না। আপনার স্বামীকে ডাক দেন, কথা বলব।’ - ক্ষিপ্ত কণ্ঠে এনজিও কর্মী আবুল কালাম কথাগুলো বললেন। স্বামীকে ডাকতে গিয়ে বার কয়েক ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো জরিনা বেগম। রাগান্বিত হয়ে আবুল কালামকে উদ্দেশ করে তিক্ত কিছু কথাও শুনিয়ে দিলো জরিনা বেগমের স্বামী, ‘যা যা, তাকে বোল্, কিস্তি দিতি পারব না নে। এ্যাক মাসের মদ্যি যেন কুনু কিস্তি নিতি না আসে। আষাঢ়ে কাইচ্চে যাক, তারপর কাজ-কাম করে টাকা হলি তকুন দেকা যাবেনে।’ উঠানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলেন আবুল কালাম। নিজামউদ্দিন তার সঙ্গে দেখা না করায় কিছুটা অপমানিত বোধ করলেন তিনি। ‘মূর্খ মানুষ মান-অপমান আর কি বুঝবে?’- এই ভেবে আবুল কালাম জরিনা বেগমের বাড়ি থেকে চলে এলেন। আসার আগে বলে আসলেন, ‘আগামী সপ্তায় ম্যানেজার স্যার আসবেন। যে করেই হোক, আপনার স্বামীকে টাকা জোগাড় করতে বলবেন, নইলে ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাব।’ কথাগুলো জরিনা বেগমের মনে কোনোরকমের ভাবনা তৈরী করতে পারল বলে মনে হলো না। বাড়িতে চাল নেই। সামান্য কিছু ময়দা আছে। তরকারি বলতেও কিছু নেই। জরিনা বেগমের অভাবী সংসারে মাঝে মধ্যে মালেকা বেগম এটা ওটা দিয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও বেশি কিছু করতে পারে না সে। তারও তো সংসার আছে! তাছাড়া তার স্বামী খুব একটা সুবিধার না। নিজামউদ্দিনের পরিবারের জন্য যা করে, সেটা তাকে গোপনেই করতে হয়। আর এ জন্য তার প্রতি দারুণভাবে কৃতজ্ঞ নিজামউদ্দিনের বউ। পরের দিন। রান্নার কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই। টানা বর্ষায় কাজকর্ম একেবারেই বন্ধ। মোল্লাবাড়ির রফিক সাহেব আগেই জানিয়েছেন, ‘শোন নিজু, আপাতত আর কাজে আসার দরকার নেই। কাইচ্চে টাইচ্চে যাক, তারপর দেখা যাবেনে।’ উপার্জনের একমাত্র উৎসটাও বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। নিজামউদ্দিনও নিয়মিত চাষ করত, গোলাভরা ধান আসত। অথচ...! - ভাবতেই বিমর্ষ হয়ে যায় তার চেহারা। স্মৃতির পাতায় সবকিছু ভেসে ওঠে- সেবার প্রবল বর্ষণে নিজামউদ্দিনের বর্গা নেয়া জমির সব ফসল পানিতে ডুবে যায়। দিশেহারা নিজামউদ্দিন ভাগের ফসলের সমপরিমাণ টাকা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকে। চাষ করার টাকাটাও যে উচ্চসুদে ঋণ নেয়া ছিল। উচ্চসুদে ঋণের এ ব্যবসা গ্রামের চিল্টু মোল্লারাই করে। সবাইকে তাদের কাছেই হাত পাততে হয়। নিজামউদ্দিনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফসল না হওয়ায় ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য সেবারই প্রথম এনজিও থেকে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। নিয়ম মোতাবেক টাকা তোলার জন্য বউয়ের সঙ্গে ছবিও ওঠে। অবশেষে টাকা হাতে হরিণাকুন্ডু থেকে বাড়ি ফেরে তারা। চিল্টু মোল্লার টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তাকে যে হিসেব দেখানো হয়, তাতে আসল টাকার চেয়ে সুদের অঙ্কই বেশি। সঙ্গত কারণে আসল টাকা আর পরিশোধ করা হয় না। সুদের টাকাগুলো পরিশোধ করে বাড়ি ফেরে সে। চিল্টু মোল্লা আগে থেকেই হিসেব কষে রেখেছে- আসল টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত হাজারে দুইশ’ টাকা হারে সুদ বাড়তেই থাকবে। নিজামউদ্দিনের মতো নিরূপায় মানুষদেরকে চুষে খাওয়ার উপায় তাদের ভালো করেই জানা। দিন যাচ্ছে, সুদের টাকা বাড়ছে। অভাব নিজামউদ্দিনের সংসারে নিত্যসঙ্গী এখন। নিজের ধানি জমিটুকু আগেই খোয়াতে হয়েছে সুদের টাকা দিতে গিয়ে। এভাবে যে চলতে পারে না, কিছু একটা করা দরকার- চৌকির উপর শুয়ে শুয়ে নিরর্থক ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে খেলা করছে। আসলেই কি কিছু করার মতো ক্ষমতা আছে তার? ইতোমধ্যে মালেকা বেগম ক’টা রুটি আর আলু ভাজি দিয়ে গেছে। খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডাকার পরও কোনো সাড়া মিলল না নিজমউদ্দিনের। এতবার ডাকাতে বেশ বিরক্ত হলো। এবার জরিনা বেগমকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, ‘মালা আর বিলকিসকে নিয়ে তুই খায়ে নে। আমার চিন্তা করা লাগবে না নে।’ কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অনেক দিন বাজারে যাওয়া হয় না। কী মনে করে ছেড়া জামাটা গায়ে দিয়েই বাজারের দিকে রওনা দিলো নিজামউদ্দিন। বাজারে গিয়ে রবিউলের চায়ের দোকানে বসল। পাশের গ্রামের ইজাল মুন্সির সঙ্গে দেখা হওয়ায় বেশ পুলকিত হলো। নিয়মিত বাজারে আসলে আগে দেখা করে মুন্সির সঙ্গে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। তাই বাজারে এলে মুন্সির সঙ্গে ওঠা-বসা একটু বেশি হয়। এখন আর আগের মতো বাজারে না আসায় সম্পর্কটা যে একটু দূরে চলে গেছে, তাতে দ্বিমত নেই তার। ইজাল মুন্সি এক কাপ চা খাওয়ালো। সঙ্গে একটি সিগারেটও। সিগারেট হাতে পেয়ে তাকে যে বেশ আনন্দিত মনে হলো তা তার মুখের দিকে তাকাতেই বোঝা গেল। যেন বহু আরাধ্য বস্তুটি হাতে পেয়ে পিপাসিত মনের তৃষ্ণা পূর্ণ হলো। অনেক দিন পর ইজাল মুন্সিকে কাছে পেয়ে মন খুলে কথা বলতে চাইল কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। অভাবী সংসারের কিছু চিত্রও তুলে ধরতে চাইল। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না। বিশেষ একটি কাজের কথা বলে ‘আবার দেখা হবেনে’ বাক্যটি উচ্চারণ করেই বিদায় নিল মুন্সি। ঘরমুখো মানুষগুলো একে একে বাজার থেকে চলে এলো। আরও কিছুক্ষণ বসে থাকল নিজামউদ্দিন। ‘চাচা যাবা না? রাত তো অনেক হয়ে গেল।’- রবিউলের কথাগুলো ঠিকমতো কানে গিয়ে পৌঁছাল কি না তা বোঝা গেল না। বাজারের প্রায় সবগুলো দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিনের কর্মব্যস্ত বাজারটিও যেন ক্লান্ত। দু’একটি হারিকেনের মৃদু আলো জ¦লছে বেশ দূরে। একটু পরে মৃদু আলোও নিভে গেল। অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হয়ে গেল। বাজারটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। রবিউলও চলে গেল। পাহারাদারদের বাঁশির আওযাজ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। ভাবনার নদীতে পূর্ণমাত্রার জোয়ারে হাবুডুবু খাচ্ছে নিজামউদ্দিন। চিল্টু মোল্লা যে তাকে ঠকিয়েছে- সে কথাও বাদ যাচ্ছে না তার ভাবনা থেকে। নিশীথের সহযাত্রী হয়ে এতক্ষণে পা বাড়াল। ওদিকে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে জরিনা বেগম। ভোরবেলা নামাজ পড়ার জন্য ওজু করতে বাইরে বের হলো হেকমত আলী। নিজামউদ্দিনের রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল তার। ঘরের সামনে গরু বাঁধা। গরু! গরু আসলো কোথা থেকে?- ভাবতে ভাবতে ওজু সেরে ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদের দিকে পা বাড়াল হেকমত। সকাল হতে না হতেই নিজামউদ্দিনের হঠাৎ পাওয়া গরুর সংবাদটি সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। নিজামউদ্দিন আগেই বউকে জানিয়ে রেখেছে, গরুটি জরিনা বেগমের মামাতো বোনের। গতকাল বাজারে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে গরুটি রেখে যায় নিজামউদ্দিনের কাছে। গরুর বাচ্চা হওয়ার পর সেটি ফেরৎ দিতে হবে বলেও জানাল জরিনা বেগমের স্বামী। নিজামউদ্দিনের হঠাৎ পাওয়া গরুর বিষয়টি কেউ সহজভাবে নিতে পারল না। সূর্য ওঠার আগেই চিল্টু মোল্লারা নিজামউদ্দিনের বাড়িতে হাজির। রান্নাঘরের সামনে বাঁধা গরুটি চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হলো না তাদের। বাঁধন খুলে গরুটি নিয়ে যেতে উদ্যত হলো চিল্টু মোল্লার ছোট ভাই। জরিনা বেগমের মেয়ে সাত বছর বয়সী মালা বাঁধা দিতে গেলে নিজামউদ্দিন মেয়ের হাত ধরে টান দেয়। জরিনা বেগম ঘরের এক কোণে নির্বাক দাঁড়িয়ে গরুটির পিছু পানে চেয়ে থাকে। মোল্লাদের ভালো করেই চেনে নিজামউদ্দিন। শুধু চিল্টু মোল্লার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গতরাতে বাজার থেকে আসার পথে চিল্টু মোল্লাদের পাড়ার দিকে যায় সে। শত চেষ্টা করেও গরুটি সরাতে পারে না অনভিজ্ঞ নিজামউদ্দিন। বিকেল বেলা। অনেক মানুষ জুটেছে মোল্লাবাড়ির সামনে। খোলা জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মাঝখানে হাত-পা বাঁধা নিজামউদ্দিন মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশে চেয়ারে বসে আছেন চেয়ারম্যান সাহেব। চেয়ারম্যান সাহেব এখনো বিচার শুরু করেননি। তার আগেই এদিক-সেদিক থেকে লাঠির বাড়ি পড়ছে নিজামউদ্দিনের পিঠে। কেউ কেউ বলছে, ‘মার, শালারে মার!’
×