ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বই ॥ কাপ্তাই বাঁধ ॥ বর-পরং

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

বই ॥ কাপ্তাই বাঁধ ॥ বর-পরং

সমারী চাকমা রচিত ‘কাপ্তাই বাঁধ : বর-পরং ডুবুরিদের আত্মকথন’ গ্রন্থটি মূলত সর্বস্ব হারানো এক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমাদের করুণ আখ্যান। যে ক্ষতবিক্ষত ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয় সেই ঔপনিবেশিক শাসনামলের ১৯০৬ সাল থেকে। কর্ণফুলী জলবিদ্যুতের জন্য তৈরি করা এক সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নিতে আরও প্রায়ই অর্ধশত বছর অপেক্ষা করতে হয়। এই অতি বাস্তব আত্মকথনটি প্রকাশনায়- কমরেড রূপক চাকমা মেমোরিয়েল ট্রাস্ট। প্রচ্ছদ পরিকল্পনায়- মহেন্দ্রনাথ গোপাল। আর ২০১৮ সালের ভাষার মাসে বইটি সবার সামনে আসে। বাস্তবতার নির্মম পেষণে অনেক জনকল্যাণকর কার্যক্রম বাস্তুচ্যুত, গৃহ ছাড়া বহু মানুষের আর্তনাদে সার্বিক পরিবেশ বিষাদময় হয়ে ওঠে। উল্লিখিত বইটি এমন এক মর্মান্তিক কাহিনীর স্পর্শকাতর প্রতিবেদন। জলবিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রামের ‘কাপ্তাই বাঁধ’ নির্মাণ যতই জনহিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করুক না কেন সেই আধুনিক প্রকল্পের শুরুটা ছিল এক জ্বালাময়ী, অস্থির ও ছন্নছাড়া জীবনযাত্রার মর্মান্তিক বেদনাঘন দীর্ঘশ্বাস। যা আজ অবধি ভুক্তভোগীদের উত্তরসূরিরা চোখের জলে তাদের পূর্ব পুরুষের অসহায় এবং সম্বলহীন দুরবস্থার নির্মম শিকারকে ভারাক্রান্তচিত্তে স্মরণ করে। গ্রন্থের রচয়িতা সমারী চাকমা ও নদীগর্ভে বিলীন হওয়া এক সর্বস্ব হারানো পরিবারের জীবন্ত প্রতিনিধি। সাধারণ ইতিহাসের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া এই আদিবাসী নারী পরবর্তীতে আইনশাস্ত্রেও তার দক্ষতা প্রমাণ করে সনদ লাভ করতে সময় নেয়নি। সেই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণে হাজার হাজার চাকমা পরিবারের জীবনে নেমে আসা সর্বনাশা দুর্ভোগকে অনেক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে যে করুণ আলেখ্য পাঠক সমাজকে উদ্বেলিত করে সেটা জানতে হলে বইটি আদ্যোপন্ত পড়া বিশেষ দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কারণ কাপ্তাই বাঁধের জলবিদ্যুত সুবিধা সারা বাংলার কিয়দংশ আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিলেও কত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, চাপা কান্না, বিপর্যয়, স্বদেশ হারানোর ব্যথা লুকিয়ে আছে তা তো সবাইকে জানতেই হবে। আর এই গুরুদায়িত্বটা সম্পন্ন করে সমারী চাকমা তার স্বজাতির প্রতি যে অকৃত্রিম মমত্ববোধ আর দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিলেন সে জন্য তাকে অনেক অভিনন্দন এবং আন্তরিক শুভেচ্ছা। বইটির উৎসর্গ পত্রে আছে এক অভাবনীয় মানবিক, কর্তব্যবোধের অবর্ণনীয় বাস্তব কথন। মা, বাবা, দাদু, ঠাকুর মা, মামা, নানু, দিদিমাকে স্মরণে এনে তাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মনুষ্যত্বের জয়গানে অভিষিক্ত করে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানালেন এই কৃতী লেখক। শুধু তাই নয় জীবনভর যারা অসম সাহসিকতা এবং সীমাহীন দুর্ভোগেও নিজেদের সদম্ভে চালিত করেছেন স্মৃতিবিজড়িত দুঃসহ সময়গুলোকে অম্লান রেখে। বর-পরং এমন একটি যাত্রাপথ যা বহু দুর্ভাগার প্রতিনিয়তই সঙ্গী ছিল। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সুপরিকল্পিত অধ্যায়ে কত যে অপরিকল্পিত, অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ পাহাড়ী নৃগোষ্ঠীর জীবনকে ছন্নছাড়া এবং অস্থির সময়ের আবর্তে ফেলে দেয় সেই করুণ ইতিহাস কাপ্তাই হ্রদের নীলজলের অতলে তলিয়ে গেলেও তার সর্বশেষ অনুচ্ছেদ আজও লোকমুখে প্রচলিত, বর্ণিত এবং বিষন্নতায় আলোচিত। সেই ঐতিহাসিক করুণ ধারাবাহিকতার এক পরিচ্ছন্ন আত্মকথন সমারীকে নানা মাত্রিকে বেদনাহত করে দেয়। গ্রন্থের শব্দ, বাক্য, ঘটনা, ইতিহাসের প্রেক্ষিত সবই সুষ্ঠু এবং পর্যায়ক্রমিক অভিগমনে পাঠককে আহত করে, এক অজানা করুণ আখ্যানে পাঠক বিমর্ষ হয়, বেদনায় সেই দুঃসময়কে স্পর্শও করতে চায় এক মানবিক, সহমর্মিতার অকৃত্রিম বোধে। গ্রন্থের রূপকারের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয় এই কাপ্তাই বাঁধের কারণে হাজার হাজার একর জমি পানিতে ডুবে যায়- যার অবধারিত পরিণতি অসংখ্য মানুষের শুধু গৃহত্যাগই নয় দেশ ছাড়ারও বেদনাঘন ইতিবৃত্ত। যাযাবরের মতো এই পথে প্রান্তরে বসতি খুঁজে বেড়ানোর অন্তহীন যাত্রা পার্বত্য এলাকার ইতিহাসে ‘বরং-পরং’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পুরো বইটা এই বিশেষ প্রত্যয়ের আবর্তে ঘুরপাক খায়, গতি পায় এবং সুনির্দিষ্ট যাত্রা পথে কোথাও না কোথাও গিয়ে আস্তানা গাড়ে। বইটি পাঠক সমাজে আদৃত হবে এবং বৃহত্তর প্রকল্পে কত অসহায় মানুষের করুণ ইতিবৃত্তও সবার সমানে স্পষ্ট হবে।
×