ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গহীন অরণ্যে শত পথ...

প্রকাশিত: ০৮:০২, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

গহীন অরণ্যে শত পথ...

ঝিঁঝিঁ পোকার ছন্দে আর সবুজের সমারহে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। আর এই নিরিবিলির ছোঁয়া পেতে আমরা যারা শহুরে তাদের অনেক কষ্টই করতে হয় বৈকি। আর সেই নিরিবিলির স্থান যদি বন হয় তাহলে আর কথাই নেই শত রাস্তার মাঝে কিছু সময় যদি বুনো পরিবেশে ঘুরে বেড়ান যায় তাহলে মন সজীব হয়ে যায়। রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজ বন। বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মাঝে মধ্যে এর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে সুরেলা পাখির কণ্ঠ। আশপাশে জনমানবের অস্তিত্ব খুব একটা চোখে পড়ে না। দুই পাশের টিলার গাছপালার ডাল নুয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর। দূর থেকে মনে হতে পারে এটা পায়ে চলার কোন রাস্তা নয়, সবুজের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার মায়াময় সুড়ঙ্গপথ। সবুজের ছাউনির এই রাস্তা বয়ে গেছে সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে। খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে শুধু এই পথ ধরে হাঁটলেই চলবে না। আপনাকে হতে হবে আরেকটু সাহসী, পরিশ্রমী। আর এই সাহসিকতার জন্য আপনি দেখা পেতে পারেন মুখ পোড়া বানর অথবা অজগর সাপ অথবা অন্য কোন প্রাণী। সিলেটে প্রায় সবাই কম-বেশি ঘুরতে গিয়েছেন কিন্তু শহর থেকে ৫ কিমি দূরের খাদিম রেইন ফরেস্টে অনেকেই যাননি। সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে জাফলং রোডে হযরত শাহ পরাণের মাজারের পর বাঁ পাশে খাদিমনগর টি এস্টেটের রাস্তা ধরে কয়েক শ’ মিটার এগোলেই বনের শুরু। এখানে দুটি ট্রেইল ধরে ট্রেকিং করতে পারেন, ছোট ট্রেইলে ৪৫ মিনিট আর বড় ট্রেইলে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। খুব কাছের দূরত্ব হওয়ার পরেও সময়ের অভাবে যেতে পারিনি খাদিম রেইন ফরেস্টে। তা ছাড়া শুনলাম সম্প্রতি খাদিম ফরেস্টে যুক্ত হয়েছে ট্রি এ্যাকটিভিটিস আর জিপ লাইন। এই নতুন দুই এ্যাকটিভিটিস স্বাদ পাওয়ার জন্যই আরও মন আকুল হয়ে উঠেছিল খাদিম ফরেস্টে যাওয়া জন্য। আমি, মা, সানন্দা আর সুকান্ত রওনা দিলাম গন্তব্য খাদিম ফরেস্টে। সিলেট শহর থেকে জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, মিরা বাজার পেরিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। বারে শুক্রবার, স্নিগ্ধ সকাল রাস্তায় তেমন যানজট নেই। তাই স্বল্প সময়ের মাঝেই আমরা পৌঁছে যাই খাদিম ফরেস্টে ঢোকার রাস্তায়। দুই পাশেই চা বাগান একদিকে খাদিম চা বাগান, অন্য দিকে বুরজান চা বাগান। বাগানের রাস্তা তাই কোথাও পিচ করা আবার কোথাও মাটির রাস্তা। রাস্তার অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা হেঁটেই পথ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পদব্রজে চলছি আমরা এগিয়ে সিলেট এ চা বাগানগুলোর পরিবেশ আসাধারণ। বাগানের বাসাগুলো দেখলেই থেকে যেতে মন চায়। প্রতিটি বাসার সমনে বাঁশের বেড়া দেয়া আর নিপুণ এক শৈল্পিক ছাপ। চারপাশে চা বাগানের অবারিত সবুজের বন্যা। চা কারখানা, চা শ্রমিকের শিল্পিত বাসস্থান দেখতে দেখতে গহীন অরণ্যের নির্জনতার দিকে ঢুকে যাচ্ছিলাম আমরা। আমরা হাঁটছি বাগানের মেঠো পথ ধরে। যত ভেতরে ঢোকা যায় নির্জনতা তত বাড়তে থাকে বিভিন্ন পাখির কলরব মনকে ছুঁয়ে যায়। পথিমধ্যে ব্যাঙের ডাক মনে করিয়ে দিল অল্প কিছুক্ষণ এর মধ্যে বৃষ্টি আমাদের বরণ করবে। অল্প কিছুক্ষণ এর মধ্যে মুষল ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো আমরা ফরেস্টের বিট অফিসে পথে হাঁটছি। অবিরাম বর্ষণের জলধারার পরশে বৃক্ষরাজি নব যৌবন লাভ করে। প্রায় ৪৫ মিনিট হাঁটার পর আমরা পৌঁছালাম ফরেস্টের বিট অফিসে। বিট অফিসে গিয়েই দেখা পেলাম নতুন দুটি এ্যাকটিভিটি যোগ হয়েছে। ১০০ টাকা করে প্রতিটি এ্যাকটিভিটির জন্য। নতুন দুটি এ্যাকটিভিটির জন্য টিকেট কিনলাম। আমাদের মতো বেশ কয়েকজন পর্যটক ও দুই এ্যাকটিভিটির জন্য টিকেট কিনলেন। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল খুব সহজ কিন্তু উপরে ওঠার পরে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ব্যাপারটা ভালই কঠিন। মনে মনে বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম এই বুঝি পরে গেলাম। বিশেষ করে লাস্ট দুইটা এ্যাকটিভিটি বেশ কঠিন। আমার ঘাম ঝরিয়ে ছাড়ল। তবে এই যাত্রাপথে কারও উচ্চতাভীতি থাকলে সমস্যায় পড়বেন। ভয় লাগবে তখন। জিপ রোলিং টা অসাধারণ। যদিও দূরত্বটা অনেক কম মনে হয়েছে আমার কাছে। মাত্র ৬-৭ সেকেন্ডেই শেষ হয়ে যাবে। এইটাতে ব্যাপক আফসোস রয়ে গেছে কেন আরও লম্বা লাইন হলো না! দুই এ্যাকটিভিটির কাজ শেষ করে সেখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে শুরু করলাম আমদের ট্রেকিং। আগেই বলেছি এখানে দুটি ট্রেইল ধরে ট্রেকিং করতে পারেন, ছোট ট্রেইলে ৪৫ মিনিট আর বড় ট্রেইলে দু’ঘণ্টা সময় লাগবে। আমরা দুই ঘণ্টার পথে যাত্রা শুরু করলাম। একদিকে বৃষ্টির অবিরাম ধারা, অন্য দিকে পাখির ডাক। আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা হাঁটছি ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। তবে বলে রাখা ভাল বৃষ্টির সময় জোঁকের আনাগোনা বেশি থাকে তাই এক জায়গায় বেশি সময় না দাঁড়ানোই ভাল। গাছে গাছে ফল ধরে আছে কাঁঠাল, দু’পাশের ঘন ডালপালা নুয়ে এসে পারায় চলা পথকে সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলেছে, কিছুটা অন্ধকার। পথের মাঝে পাবেন স্বচ্ছ পানির খাল– স্থানীয়ভাবে যাকে ছড়া বলে, বৃষ্টির পর পর এগুলো বিপুল বেগে পানি বহন করে, অন্য সময় হাল্কা একটা ধারা বজায় থাকে, কিংবা শীতকালে একেবারে শুকিয়ে যায়। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে, কপালে কি আছে দেখাই যাক না। রিমঝিম বৃষ্টির আওয়াজ আর একটানে ডাকা ঝিঁঝিঁ পোকার লহরী। কাদামাখা পায়ে ছপ ছপ শব্দ করে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছি আমরা। ইতোমধ্যে অবশ্য রক্তদান প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, পা থেকে টেনে জোঁক উঠলাম দুটো। সামনে ট্রেইলটা আরও সরু, জঙ্গল বর্ষার পানিতে একদম ঘন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ছড়া বয়ে গেছে বেশকিছু। খুব বেশি হলে হাঁটু পানি হবে, মানে এগুলো বর্ষাকালীন ছড়া। পাড়ের বালুটা খুব নরম, পা দিতেই চোরাবালির মতো দেবে গেল। একটু টিলার মতো জায়গা পেরিয়ে আবার মোটামুটি সমতল। পথে দেখা পেলাম বানর দল এর কিন্তু ছবি তোলার আগেই নিমিষে বানর দল হারিয়ে গেল গভীর বনের দিকে। আরও কিছু দূর যাওয়ার পর দেখা পেলাম বিরল প্রজাতির মুখপোড়া হনুমান। সেই বিশাল লম্বা লেজ আমাদের সঙ্গে দেখা পেলাম কয়েকটা বাচ্চা হনুমানের পেছন ধরেছে। পাশের এক দোকান থেকে কলা কিনে এনে দিল। কলা পেয়ে হনুমান মহোদয়কে বেশ উৎফুল দেখলাম। আমাদের গাইড বিভিন্ন প্রজাতির গাছ চিনেয়ে দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে জঙ্গল এমনই গভীর হয়ে গেল যে, আর হাঁটা যাচ্ছে না, শুরু হলো বসে বসে ক্রল করা। ওপরে আবার বেতের ঝাড় আর কিছু নাম না জানা কাটাগাছ। হাতে-পায়ে গায়ে সমানে আটকে যাচ্ছে কাটাগুলো, আমরা বসে বসে এগোচ্ছি আর উপরে বৃষ্টি। ঘন জঙ্গল, বিশাল লম্বা লম্বা দেশী-বিদেশী গাছে ঢাকা পথ হেঁটে আরও দু-একটা ঝিরি পার হলাম, সামনে এসে দাঁড়ালো দুর্ভেদ্য জঙ্গল। একদম ডেড এন্ড, গাছ না কেটে আগানোই যাবে না। আমাদের গাইড দা দিয়ে ঝোপ কেটে আমাদের রাস্তা করে দিলেন। পায়ের দিকে তাকালেই ঝামেলা, জোঁক তুলতে হয়। এই চিনা জোঁক জিনিসটা খুবই খারাপ। বেশ কয়েকজন ভয়ে ফিরে যেতে চাছিলেন কিন্তু ফেরার উপায় না পেয়ে আমরা আবার ফিরে চললাম ট্রেইল ধরে। ততক্ষণে অবশ্য এক ঘণ্টার বেশিই হয়ে গেছে। বনের ভেতরে নির্জনতা আর মনের ভেতরের ভয় সব মিলিয়ে এক বিচিত্র সময় পার করছিলাম আমরা। সামনে কি আছে তা আমরা জানি না এক মাত্র আমাদের গাইডই বলতে পারেন তবে ভাগ্যিস আমারা গাইড পেয়েছিলাম তা না হলে আমাদের ফরেস্টের ভেতর থেকে বের হওয়া কঠিন কাজ ছিল। অদূরে চা গাছের আড়ালে সূর্য ঢলে পড়েছে। শেষ সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল আকাশজুড়ে। সেই সঙ্গে অগণিত পাখির নীড়ে ফেরার ব্যাকুলতা। বন গোধূলির স্পনিল মোহে আছন্নে হয়ে কখন যে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার আঁধারে ঢুকে গেছে টের পাইনি। কিভাবে যাবেন – ঢাকা থেকে বাস অথবা ট্রেনযোগে সিলেট। সিলেট শহরের বন্দর বাজার থেকে খাদিম যাওয়ার জন্য টাউন বাস/ সিএনজি প্রতিনিয়ত ছাড়ে। শাহ পরাণ মাজার সামনে নেমে মাজার জিয়ারত করে সহজে আপনার কাক্সিক্ষত যাত্রাপথে রওনা দিতে পারেন। তবে দল বড় হলে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ঢোকাই ভাল।
×