ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেষ হলো জমজমাট প্রচার, একদিন পর ভোট

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

শেষ হলো জমজমাট প্রচার, একদিন পর ভোট

শাহীন রহমান ॥ নানা ঘটনা ও নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হলো নির্বাচনের প্রচার। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে গত ১৮ দিন ধরেই প্রার্থীরা ছিলেন ভোটের মাঠে। তবে ভোটের মাঠে পুরো সময় ধরেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সরব উপস্থিতি থাকলেও প্রচারের ক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট তথা ধানের শীষ প্রার্থীদের বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। যদিও তারা অভিযোগ করেছে ক্ষমতাসীন সরকার ও পুলিশ প্রশাসন তাদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়েছে। ফলে ভোটের মাঠে তারা নামতেই পারেনি। নির্বাচনী প্রচারের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে প্রতিপক্ষের হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তবে সহিংসতার মাত্রা বিশ্লেষণ করলে অন্যবারের চেয়ে এবারের সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে অনেক কম। এর আগের নির্বাচনে যেখানে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেখানে এবার সহিংসতায় নিহত হয়েছে ২ জন। প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়ে আওয়ামী লীগের দুই কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই ঘটনার পর বলেন, তিন শ’ আসনের নির্বাচনে চেয়েও একজন ব্যক্তির জীবন অনেক মূল্যবান। নির্বাচনে সহিংসতা কারও কাম্য নয় উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানান। এর বাইরেও এবারের নির্বাচনী প্রচারকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষের হামলায় প্রার্থীসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনিক বিএনপি প্রার্থীরাও ভোটের মাঠে নেমে আক্রমণের শিকার হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে বিএনপি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ বেশ কয়েকজন প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন। প্রচারের শেষে এসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিয়েছে। এমনকি ইসিতে দুই দলের পক্ষ থেকেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে ব্যবস্থা নেয়া আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়াও নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের বিস্তর অভিযোগ করেছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এসেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপিসহ কয়েকটি দল থেকে। বিচ্ছিন্ন এসব ঘটনা মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে এবারের নির্বাচনী প্রচার। আরপিরও বিধান অনুযায়ী আজ শুক্রবার সকাল ৮টার পর থেকে কোন প্রার্থী ভোট চাইতে নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারবেন। তবে গোটা নির্বাচনী এলাকা এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভোট সুষ্ঠু করতে শেষ মুহূর্তে ইসিতে প্রস্তুতিও চলছে। নির্বাচনী প্রচার নিয়ে এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে সারাদেশে সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ, বিরাজ করছে। তিনি উল্লেখ করেন দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তবে নির্বাচনী প্রচার এবং লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে ইতোমধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরল হুদা ও ইসি মাহবুব তালুকদার। মাহবুব তালুকদার এর আগে বলেন, আমি মনে করি দেশে এখন নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়নি। এর জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন সুন্দর নির্বাচনী পরিবেশ রয়েছেন। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলে যে বক্তব্য মাহবুব তালুকদার দিয়েছেন তা সত্য নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে শুরু থেকে নির্বাচনী প্রচারের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোটের মাঠে যেমন ছিল সরব উপস্থিতি। অপর দিকে প্রচারের ক্ষেত্রে বিএনপির তথা ঐক্যফ্রন্টের ততটাই পিছিয়ে ছিল। এমনি ঢাকাসহ কোথাও তাদের পোস্টার পর্যন্ত লাগাতে দেখা যায়নি। তবে সব সময় বিএনপি পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের নির্বাচনী প্রচার চালাতে দেয়া হয়নি। প্রচারে নামলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ও পুলিশী বাধার মুখে তারা প্রচারে অংশ নিতে পারেনি। পোস্টার পর্যন্ত লাগাতে দেয়া হয়নি। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ও পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ পর্যন্ত দল থেকে করা হয়েছে। তবে সরজমিনে দেখা গেছে বিএনপি কোথাও তাদের পোস্টার লাগাইনি। অপরদিকে প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিন শ’ আসনের আওয়মী লীগের প্রার্থীরা সরগরম প্রচারের অংশ নিয়েছেন। শেষ দিনেও সকাল থেকেই সন্ধ্যা অবদি আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারের সরব ছিলেন। ঢাকার সব আসনেই আওয়মী লীগের প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকদের নির্বাচনী শোডাউন, মাইকিংসহ অন্য মাধ্যমে প্রচারের অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে ভোটের মাঠে বাধা পেয়ে তারা নির্বাচনী প্রচার থেকে বিরত থেকেছে। তারা অপেক্ষা করছিল মাঠে সেনাবাহিনী নামলেই তারা প্রচারের নেমে পড়বেন। শেষ মুহূর্তের তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। সেনাবাহিনী এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামার পরও তাদের কোন প্রার্থী বা কর্মীকে নির্বাচনে মাঠে দেখা যায়নি। অপরদিকে ঢাকার প্রত্যেক আসন ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে গোটা নির্বাচনী এলাকা। এর বাইরে ইসলামী দলের প্রার্থী এমনকি বামপন্থী দলের প্রার্থীদের পোস্টার দেখা গেছে। নৌকা মার্কার পাশাপাশি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকে প্রচারও ছিল লক্ষণীয়। দলটির পক্ষ থেকে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দেয়া হয়েছে। ৩শ’ আসনের মধ্যে তারা ২৯৯ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। অপরদিকে বাম জোটের প্রার্থীকে জোনায়েদ সাকিও নির্বাচনী প্রচারের যথেষ্ট সরব ছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-১২ পোস্টারে চেয়ে গেছে। নির্বাচনী প্রচারের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে ঢাকা মহানগরীর ১৫ আসনের মধ্যে ঢাকা-৮ ও ৯ আসনের প্রার্থী বাদে অন্য আসনে বিএনপি তথা ধানের শীষের প্রার্থী আছে কি নেই ভোটার এখন পর্যন্ত অবগত নয়। প্রার্থিতা প্রত্যাহার শেষে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন প্রার্থীরা। ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী আজ শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন ধরনের মিছিল মিটিং বা জনসভা করা যাবে না। নির্বাচনী এলাকায় এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভোটের পরিবেশ ঠিক রাখতে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রার্থীরা প্রচারের অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে মাইক ব্যবহার অনুমতি ছিল বেলা ২টার থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। আইন অনুযায়ী প্রতিনিটি নির্বাচনী এলাকায় ২টার বেশি মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। এবারের নির্বাচনী প্রচারের মিছিল জনসভার পাশাপাশি প্রায় সব আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ওঠান বৈঠক ও ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট ও দোয়া চাওয়া দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ঢাকার বিএনপির প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েনি। তবে পোস্টার না লাগালে ভোটের মাঠে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস অনেকটাই সক্রিয় ছিল। প্রতিদিনই নির্বাচনী এলাকায় লিফলেট বিতরণ এবং ভোট চেয়ে দুয়ারে দুয়ারে গেছেন। এর বাইরে রাজধানীর অন্য কোন আসনে কোন প্রার্থীকে প্রচারের নামতে দেখা যায়নি। এমনি ঢাকার আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থী কারা তা সাধারণ ভোটার জানে না। ঢাকার-১৪ আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে এবারেই প্রথম মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনী করছেন আবু বক্কর সিদ্দিক। রাজনীতির মাঠে তিনি একবারেই অপরিচিত। গোটা নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও তার পোস্টার নেই। এমনকি এলাকার ভোটাররা তার নাম পর্যন্ত জানে না।
×