ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযোগের বহর

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

অভিযোগের বহর

অভিযোগ আনা সহজ। তাতে যদিও না থাকে সারবস্তু, তবু অভিযোগ করার সুযোগটুকু হাতছাড়া করতে চায় না তারা। এও এক ধরনের মানসিক তাড়না। খেলায় হেরে যাবার সম্ভাবনা থাকলে তা ভ-ুল করে দেয়ার প্রবণতা যেমন থাকতে পারে, তেমনি পরাজয়ের গ্লানি মোচনেরও একটি উপায় হিসেবে স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অযথা অভিযোগ করার প্রবণতা সবার থাকে না। কিন্তু রাজনীতিতে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কমতি থাকে না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কল্পিত, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা চাতুরিপূর্ণ অভিযোগের নহর বইয়ে দেয়ার ঘটনা কম নয়। ‘কলতলার ঝগড়া’ বলে বাস্তবিক একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল গত শতকের সত্তর দশকে। সে সময়ে শহরে রাস্তার পাশে ওয়াসার কল থেকে বা গ্রামে ডিপটিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করতে হতো। শহরে কাজের বুয়া বা বস্তিবাসীরা ভোর হতেই কলতলায় পানি সংগ্রহের জন্য কলস, বালতি বা অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে দাঁড়াত। বিশাল লাইন হতো। গ্রামীণ জীবনেও তাই। এই লাইন নিয়ে ঝগড়া বিবাদ থেকে মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানির ঘটনা ঘটত প্রায় নিত্যদিন। বিষয়টি যখন পরিণত হয় অভ্যাসে, তখন অযথা বাহানা তুলে গালাগালি করার প্রবণতার বিস্তার ঘটত। ঝগড়ার বুলিতে কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হতো। শ্লীল-অশ্লীল ভাষার এমন প্রয়োগ সহজে মিলত না। সে যুগ হয়েছে বাসি। কিন্তু গালাগালি, হুমকি-ধমকি আর অভিযোগের বহর স্তব্ধ হয়ে যায়নি। এত কথা মনে আসে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের ‘পালের গোদা’ ঐক্যফ্রন্ট ও তদীয় নেতাকুলের অভিযোগের লম্বা ফিরিস্তি দেখে। কার্যকারণ ছাড়া কিংবা ঘটনা না ঘটলেও অভিযোগনামা দাখিল করার জন্য তাদের দৌড়ঝাঁপ আর লম্পঝম্প বেশ উন্মাতাল করে তুলছে জনগণকে। আইনের শাসন কিংবা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি সবসময় হম্বিতম্বি করে এসেছেন, আদালতে দাঁড়িয়ে নীতি নৈতিকতার বয়ান প্রদান করেছেন, তিনি এখন সামান্য আঙ্গুলের নখ উল্টে যাওয়া কিংবা নাকে সর্দির বিষয় নিয়ে অভিযোগ তুলে গলাবাজি করছেন শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট দফতরে গিয়ে ধমক-ধামকও দিচ্ছেন। আরও এক ধাপ এগিয়ে অতীতের সব অর্জন মুছে ফেলে গালাগালির ভাষা প্রয়োগ করে ঢেঁকুর তুলছেন আত্মতৃপ্তির। এতে নিজে সুখ, আনন্দ পেলেও জনচিত্ত যে স্বাভাবিকভাবে তা নিচ্ছে না, সে নিয়ে ভ্রƒক্ষেপও নেই। যুদ্ধাপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষার যে মহান ব্রতে তিনি অশীতিপুর বয়সে নেমেছেন মাঠে, তাতে তাদের আগলে রেখে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হেন কাজ নেই, যা করতে দ্বিধা বোধ করছেন না। অভব্য, অসভ্য, অশোভন, অশ্লীল, কদাকার আচরণ দিয়ে নিজেকে সেভাবে জাহির করছেন, তাতে স্পষ্ট হয়, উন্মাদনার জোয়ারে ভাসতে ভাসতে তিনি ঘাট-অঘাট, সুস্থ-অসুস্থ, ভাল-মন্দ একাকার করে দিচ্ছেন। নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করেছে বিএনপি ও তাদের উদ্ধারকারী ঐক্যফ্রন্ট। কখনও দলীয় ব্যানারে, আবার কখনও নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে অভিযোগ অহর্নিশি পেশ করেই যাচ্ছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে বুধবার পর্যন্ত ৫৩৫টি অভিযোগ পেশ করেছে তারা। এবারের মতো এতবেশি অভিযোগ অতীতে কখনও জমা পড়েনি। এসব অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশই বানানো কিংবা অযথা। ঘটনা ঘটুক আর নাই ঘটুক অভিযোগ একটা দাখিল করতেই হবে এবং তা নির্বাচনকে ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই। অবশ্য অনেক অভিযোগ কমিশন খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে সেসব আচরণবিধি সংক্রান্ত দলীয় কোন্দলে নিজেরা মারামারি করেও প্রতিপক্ষের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দিয়ে অভিযোগের ফিরিস্তি বাড়াতে তারা বেশ তৎপর। এসব কোন ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তা স্পষ্ট হবে সহসাই। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে আরও অভিযোগনামা দাখিল হবে হয়ত। তবে এসবই নির্বাচনকে স্বচ্ছ, অবাধ, নিরপেক্ষ করার বিরুদ্ধাচরণেরই নামান্তর।
×