ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সাইদুল আনাম টুটুল

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সাইদুল আনাম টুটুল

ক’দিন আগেও যে নামটি ছিল আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পাঙ্গনে একটি জ্বলন্ত প্রদীপ। চলচ্চিত্র, নাটক নির্মাণ বা চিত্র সম্পাদনায় যিনি ছিলেন অত্যন্ত গুণী এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, তিনি সাইদুল আনাম টুটুল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য এক উজ্জ্বল নাম। দীর্ঘ ঊনচল্লিশ বছর ধরে চিত্র সম্পাদনা এবং পরিচালনা করে এসেছেন বেস সুনামের সঙ্গে। চিত্র সম্পাদক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্র সম্পাদক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ‘ঘুড্ডি’, ‘দহন’, ‘দীপু নাম্বার টু’ ও ‘দুখাই’র মতো জীবনমুখী সিনেমার চিত্র সম্পাদক তিনি। শিল্পের প্রতি আন্তরিক দায়িত্ব বোধে গড়ে তোলেন নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘আকর’। এক রকম কোন কিছু না বলে হঠাৎ-ই গত মঙ্গলবার চলে গেলেন এই কর্মবীর জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও চিত্র সম্পাদক। কি এমন বয়স হয়েছিল এই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে যে তাকে চলে যেতে হবে মাত্র ৬৮ বছর বয়সে। সাইদুল আনাম টুটুলের জন্ম ১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল পুরান ঢাকায়। সরকারী মুসলিম স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় টুটুল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিও তাতে যোগ দেন। ৬ নম্বর সেক্টরের আওতায় খুলনা অঞ্চলে সম্মুখ সমরে অংশ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন টুটুল; কিন্তু তার ঝোঁক ছিল চলচ্চিত্রেই। ১৯৭৪ সালে ভারতের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান পুনের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। সেখানে চলচ্চিত্র সম্পাদনার ওপর পড়াশোনা শেষ করে তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সরকারী অনুদানে নির্মিত সাইদুল আনাম টুটুলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আধিয়ার’ মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। ২০০৯ সালে তার নির্মিত তিনটি নাটক বখাটে, আপন পর ও নিশিকাব্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাইকেল চালিয়ে জীবিকা অর্জন করে এমন একটি পরিবারের গল্প নিয়ে ২০১১ সালে নির্মাণ করেন এক পর্বের নাটক হেলিকপ্টার। এতে সাইকেল চালকের ভূমিকায় অভিনয় করেন আজিজুল হাকিম। এরপর তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ হচ্ছে ৫২ গলির এক গলি, অপরাজিতা, মৃতের প্রত্যাবর্তন, শিউলিমালা, কুটে কাহার, গোবরা চোর। প্যাকেজ নাটকের রং বদলে দেয়া প্রথম পুরুষ সাইদুল আনাম টুটুল। সিনেমার মতো করে যে নাটকের শূটিং করা যায়, সেটা তিনিই দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কালজয়ী সব নাটকের নির্মাতা তিনি। ২০১৪ সাল থেকে তিনি এটিএনবাংলা ও ব্যাকড্রপ লিমিটেডের যৌথ আয়োজনে নির্মিত এটিএন বাংলায় প্রচারিত টেলিভিশন নাটক বিষয়ক রিয়েলিটি শো ‘রয়েলে টাইগার নাট্যযুদ্ধ’-এর বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন। কালবেলা নামে নিজের নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারী অনুদান পান তিনি। দেশের বিভিন্ন ঘুরে কালবেলার চিত্র ধারণের কাজ কিছু দিন আগে শেষ করেছেন। চলছিল সম্পাদনার কাজ। এর মধ্যে তার হঠাৎ প্রস্থান চলচ্চিত্র শিল্পাঙ্গনে অপরিমেয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকের কাজও করতেন টুটুল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজনে ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি চলচ্চিত্র ভাষা ও চলচ্চিত্র সম্পাদনা বিষয়ে পাঠদান করতেন। টুটুল বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের ধারায়ও প্রভূত পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি প্রায় চার শতাধিক বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন। কর্মজীবন এবং শিল্প আন্দোলনে সাইদুল আনাম টুটুল যে অসামান্য অবদান রেখেছেন দেশ এবং দেশের মানুষ তাকে নিশ্চয়ই মনে রাখবে।
×