ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

সরব ছিল ঢাকার মঞ্চ

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

সরব ছিল ঢাকার মঞ্চ

ঢাকার মঞ্চ নতুন পুরনো নাটক মিলিয়ে বেশ সরব ছিল এ বছর এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বছরজুড়ে সপ্তাহের প্রায় বেশিরভাগ দিনই নাটক সরণি কিংবা শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চগুলো উৎসবমুখর ছিল। পুরনো নাটকগুলো যেমন স-উৎসাহে মঞ্চস্থ হয়েছে আবার তেমনি বেশকিছু নতুন নাটক এসেছে ঢাকার মঞ্চে। ১৫ এপ্রিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় তাদের উৎসবকে কেন্দ্র করে মঞ্চে এনেছে ইতালীয় নাট্যকার দারিও ফো ও ফ্রাঙ্কা রামে রচিত এবং সারা যাকের নির্দেশিত ‘ওপেন কাপল’ নাটকটি। এই নাটকে মানব মানবীর বিবাহ বহির্ভূত এক নিষিদ্ধ সম্পর্কের খারাপ পরিণতির রসায়নকে বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজের দর্শকদের নিকটে অতি সাহসের সঙ্গে মঞ্চায়ন করা হয়েছে। যেটি আমাদের সমাজেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হলেও কেউ কখনও উচ্চারণ করতে চায় না। আর তাই তো মজার ব্যাপার হলোÑ এরই মধ্যে নাটকটি দর্শক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে। ঢাকায় আটটি এবং লন্ডনে দুটি সফল মঞ্চায়ন হয়েছে নাটকটির। এছাড়া নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রায় তিন দশক আগে ব্রেটল ব্রেশটের ‘দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি’ অবলম্বনে অধ্যাপক আবদুস সেলিমের অনুবাদে আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি মঞ্চে এনেছিল। এরপর নিয়মিত মঞ্চায়নে নাটকটি ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু বিগত বিশ বছর নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ ছিল। এ বছর দুই দশকের বিরতি কাটিয়ে গত ৫ অক্টোবর নাটক সরণির নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তনে একটি সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে নাটকটি ঢাকার মঞ্চে পুনরায় ফিরে আসে। এর মধ্যেই আরও একাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে। নাটকটির নবরূপায়ণে নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার। মূলত এটি বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর জীবনীকে উপজিব্য করে রচিত। যেখানে দেখানো হয়েছে সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার ধর্মান্ধতা, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচারের চেষ্টা, সত্যকে প্রচার না করে বরং সত্য প্রচারকারীকে নির্মমভাবে শাস্তি দেয়া। বিষয়গুলো আমাদের এখনকার সমাজ ব্যবস্থাতেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আর এজন্যই শুরুতে যেভাবে সাড়া পড়েছিল নবরূপায়নেও ঢাকার মঞ্চে নাটকটি ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৮১ সালে ঢাকার মঞ্চে আসা আরণ্যকের কালজয়ী নাটক ‘ইবলিশ’ এ বছর ৩০ অক্টোবর দ্বিতীবারের মতো আবার নতুন করে মঞ্চায়ন হয়। মামুনুর রশীদের লেখা ও নির্দেশনায় দেশ-বিদেশের মঞ্চে নাটকটির শতাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল এই নাটকের প্রদর্শনী। ২০১৭ সালে দীর্ঘদিন পর আরণ্যকের ৪৫ বছর পূর্তি উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রথম ‘ইবলিশ’ নাটকটি নতুন করে ঢাকার মঞ্চে ফিরে আসে। একটি গ্রামীণ জনপদের রাজনৈতিক চিত্র আর সেখানে কিছু নোংরা মানুষের নষ্ট রাজনীতির শিকার হওয়া মানুষের গল্প নিয়েই নাটক ‘ইবলিশ’। ৩৭ বছর আগের চিন্তা চেতনায় রচিত নাটকটি যেন ২০১৮ সালে এসেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিয়েছে। তাই তো দর্শক এত বছর পর এসেও নাটকটিকে সাদরে গ্রহণ করেছে। বছরের একবারে শেষ প্রান্তে ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মঞ্চে যুক্ত হয় দুটি নতুন নাটক। শিমুল ইউসুফের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটারের নাটক ‘পুত্র’ জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। ঢাকা থিয়েটারের নতুন প্রযোজনাটি সেলিম আল দীনের সর্বশেষ রচনা। পুত্র হারানো এক দম্পতির বিলাপ ও স্মৃতিকাতরতার এক উপাখ্যান এ নাটক। অন্যদিকে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চের প্রযোজনায় আফরিন হুদা তোড়ার নির্দেশনায় নাটক ‘বহিপীর’ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়।‘বহিপীর’ নাটকটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচনা করেছিলেন উনিশ শতকের শেষভাগ বা বিশ শতকের সূচনালগ্নের পটভূমিতে। এছাড়া ঢাকা পদাতিকের ‘ট্রায়াল অব সূর্য সেন’, থিয়েটার (আরামবাগের) ‘দ্রৌপদি পরম্পরা’, প্রাঙ্গণেমোরের ‘হাছনজানের রাজা’, পালাকারের ‘উজান মৃত্যু’সহ বেশ কিছু নতুন নাটক ঢাকার মঞ্চে এসছে। হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের কয়েকটি নাট্যৎসব। এ বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন নাটক এসেছে এবং পুরনো নাটকের নবরূপায়ণ যেমন হয়েছে তেমনি বিগত কয়েক বছর যাবত মঞ্চায়ন হওয়া নাটকগুলোরও মঞ্চায়ন হয়েছে সমানতালে। এর প্রধান কারণ হতে পারে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক তথা সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বছরব্যাপী প্রতিটি শোতে দর্শক উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। আজকের এই সময়ে একটি প্রজন্মের নিকট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবের প্রচ- দাপট এ কথা মানতেই হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যখন তাদের বেশিরভাগ সময় এই মাধ্যমগুলোতে কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তখন মঞ্চনাটক কী দর্শক টানতে পরবে এরকম একটি প্রশ্ন সামনে আসা স্বাভাবিক নয় কী? কিন্তু না আমাদের তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ আমাদের মঞ্চেরও যথেষ্ট সমঝদার এ কথাটিও প্রমাণিত হয়েছে। মঞ্চের শক্তি এখানেই। মঞ্চের যে একটি আলাদা স্বকীয় শক্তি আছে এ বছরের মঞ্চ গতিধারা তাই প্রকাশ করেছে। জয় হোক মঞ্চ নাটকের; জয় হোক মঞ্চের।
×