ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক অঙ্কের নির্দেশনা লঙ্ঘন

গৃহঋণে এখনও উচ্চ সুদ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

গৃহঋণে এখনও উচ্চ সুদ

রহিম শেখ ॥ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গৃহায়ণ ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ আদায় করছে। সুদের পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ, কমিশনসহ আদায় করছে বিভিন্ন ধরনের ফি। এতেও ঋণের খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে। সার্ভিস চার্জ ও কমিশন বাবদ যে অর্থ আদায় করা হয় সেগুলোর কারণে ঋণের খরচ ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও তিন মাস পর পর সুদের অঙ্ক মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করার কারণে বেড়ে যাচ্ছে মূল টাকার পরিমাণ। এতে গ্রাহক নিয়মিত ঋণ শোধ করে এক দুটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেই ঋণের অংক বেড়ে যায়। এ খাতে ঋণের সুদের হার ৯ থেকে ১৬ শতাংশ হলেও বাস্তবে এসব মিলে সুদের হার ১৪ থেকে ২০ শতাংশ পড়ছে। হিসাবের মারপ্যাঁচ করে তারা ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে ওই হারে উচ্চ সুদ আদায়ের কারণে বাড়ি নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কেনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে এ খাতে ঋণ প্রবাহ যেমন কমছে, তেমনি গৃহায়ণ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গৃহায়ণ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সুদ ছাড়াও মোট ঋণের ওপর নানা ধরনের সেবার ফি ও কমিশন আরোপ করেছে। এর মধ্যে ঋণ প্রসেসিং ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, যাচাই ফি, মনিটরিং ফি, হিসাব খোলা ও পরিচালনার ফি আদায় করছে। এর মধ্যে ব্যাংক বেদে ঋণ প্রসেস করার জন্য প্রসেসিং ফি ০.৫০ থেকে ১ শতাংশ আদায় করে। অনেক ব্যাংক গৃহায়ণ খাতের ঋণ বাইরের কোন এজেন্সি দিয়ে তদারকি করে। এক্ষেত্রে তারা আলাদা ১ শতাংশ হারে ঋণ তদারকির জন্য ফি বাড়তি আদায় করে। ঋণ দেয়ার আগে কোন কোন ব্যাংক জমি বা ফ্ল্যাটের ব্যাপারে আলাদা কোন এজেন্সি দিয়ে খোঁজ খবর করায়। এক্ষেত্রে মোট ঋণের বিপরীতে ১ থেকে দেড় শতাংশ হারে বাড়তি ফি আদায় করে। এসব কারণে ঋণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে ব্যাংকগুলো সব ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। সরকারী চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক কেবলমাত্র এ খাতের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। অন্য কোন ব্যাংক এখনও ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনেনি। এ বিষয়ে বেশকিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক করছে যাচ্ছে তাই। ব্যাংকটি গৃহঋণের সুদ নিচ্ছে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণে সুদ কাটছে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ পর্যন্ত। যা ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। কয়েক মাস ধরে কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ বহু গ্রাহককে ২ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। গৃহঋণের ক্ষেত্রে যাদের ৯ শতাংশ সুদ ছিল তাদের করেছে ১১ শতাংশ। আর যাদের ১০ শতাংশ সুদ ছিল তাদের করেছে ১২ শতাংশ। কারও করেছে ১৩ শতাংশ। নিয়মানুযায়ী একসঙ্গে দুই শতাংশ সুদ বাড়াতে পারে না। তবুও ব্যাংকটি তাই করছে। এছাড়া ১ জুলাই থেকে সব ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা ছিল। কিন্তু কোনটিই কার্যকর হয়নি। এতে ব্যাংকিং খাতে সুদারোপে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে ব্র্যাক ব্যাংকসহ বেশকিছু ব্যাংক। ২২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বেসরকারী খাতের এনআরবি ব্যাংক গত অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট কেনার ঋণে সুদ নিয়েছে ১০ থেকে ১১ শতাংশ। নবেম্বর থেকে ফ্ল্যাট কেনার ঋণে সুদহার বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে ব্যাংকটি। বেসরকারী খাতের প্রথম প্রজন্মের প্রাইম ব্যাংক গত অক্টোবরে ফ্ল্যাট কেনার ঋণ বিতরণ করেছিল ১০ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে। নবেম্বর থেকে ফ্ল্যাটের ঋণে সুদ বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। এছাড়া গৃহায়ণ ঋণের বিপরীতে ইস্টার্ন ব্যাংক সাড়ে ১০ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ, সিটি ব্যাংক সাড়ে ১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক ১১ শতাংশ, ইউসিবি ১১ শতাংশ, আইএফআইসি ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ, লঙ্কাবাংলা ১৪ শতাংশ, আইডিএলসি সাড়ে ১৩ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়া ১১ শতাংশ, ডিবিএইচ ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ, এবি ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ, আইপিডিসি ১৪ দশমিক ২৫ থেকে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১২ শতাংশ মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১৩ শতাংশ এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গৃহঋণে ১১ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। তবে এ সময়ে শুধু ডাচবাংলা ব্যাংকের গৃহঋণের সুদেও হার ছিল ৯ শতাংশ। এছাড়া সরকারী খাতের চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এ খাতে সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ গৃহায়ণ ঋণ দান সংস্থাও এ খাতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে এসেছে। তবে এর বিপরীতে নানা সার্ভিস চার্জের কারণে এ হার আরও বেশি পড়ছে। জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, গাড়ি ও বাড়ির ঋণ ব্যাংকের বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এখন বেশি জোর দিচ্ছে কর্মসংস্থানমুখী শিল্প ঋণে সুদহার কমানোর ওপর। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিষ্ঠানের আমানত নিতে ৯ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সব ক্ষেত্রে সুদহার কমানোর সুযোগ কম বলে তিনি উল্লেখ করেন। ব্যাংকাররা জানান, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা না করে সুদহার এক অঙ্কে নামানোর বিষয়টি ব্যাংকগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে শিল্প ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামানোর জন্য নানান চাপ রয়েছে। ঋণের সুদহার কমানোর চাপ থাকলেও কীভাবে আমানত পাবে, তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রে এখনও ১১ শতাংশের বেশি সুদ থাকায় মেয়াদী আমানতকারীরা সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন। আবার সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত নিতে ব্যাংকগুলোকে ৮ শতাংশের বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমানত সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। এ কারণে মুনাফায় সামঞ্জস্য রাখতে বড় শিল্পের বাইরে ঋণের খুব বেশি সুদ কমাতে পারছে না। যদিও সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে সুদহার বৃদ্ধির যে একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছিল, এখন আর তা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যাংক সুদহার কমিয়ে আনছে। যে কারণে ব্যাংক খাতের গড় সুদহার কমতির দিকে রয়েছে। নানামুখী তৎপরতার পরও অধিকাংশ ব্যাংক গত ১ জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদ কার্যকর না করায় ২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গবর্নর ফজলে কবিরের উপস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে জানানো হয়, ৯ আগস্ট থেকে ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তা ঋণ বাদে অন্য সব ঋণে সিঙ্গেল ডিজিট সুদ কার্যকর করবে তারা। সিঙ্গেল ডিজিট সুদ কার্যকরের জন্য সরকারী সংস্থার আমানত ৬ শতাংশের কম সুদে বেসরকারী ব্যাংকে রাখা এবং সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর দাবি জানানো হয়। সরকারী সংস্থার আমানত কম সুদে বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে দেয়া হলেও নির্বাচনের আগে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হবে না বলে জানিয়ে দেন অর্থমন্ত্রী।
×