ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েক মাসে জামায়াত বিএনপি ৫শ’ কোটি টাকা ছড়িয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

কয়েক মাসে জামায়াত বিএনপি ৫শ’ কোটি টাকা ছড়িয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ টাকা ছড়িয়ে সারাদেশে নাশকতা চালিয়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ৮ কোটিসহ গ্রেফতারকৃত সেই তিন বিএনপি নেতাকর্মীকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। জব্দ করা টাকাগুলো দুবাই থেকে অবৈধভাবে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টাকাগুলো অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকা বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্তকারীরা। নির্বাচনে নাশকতা চালাতে ঢাকায় ইউনাইটেড কর্পোরেশনের মতো আরও ভাসমান গোপন অফিস থাকতে পারে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। এমন অফিসের খোঁজে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মতিঝিলের অফিসটি থেকে সারাদেশে নাশকতা চালাতে দেড়শ’ কোটি টাকা নয়, আরও বেশি টাকা ছড়ানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে বিএনপি-জামায়াত অন্তত পাঁচশ’ কোটি টাকা ছড়িয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য মিলেছে। এসব টাকা অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকা বলে অনেকটাই নিশ্চিত। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। এসব টাকার মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে এবং অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং ইনভেস্টিগেশন স্কোয়াড ও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল মতিঝিল সিটি সেন্টারের ২৭ তলায় অভিযান চালিয়ে ইউনাইটেড কর্পোরেশন নামের একটি আমদানি রফতানি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী হায়দারকে (২৪) গ্রেফতার করে। তার সঙ্গে থাকা গুলশানের আমেনা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) জয়নাল আবেদিন (৪৫) ও ঝালকাঠি অফিসের ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেনকে (৩৮) গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৮ কোটি নগদ টাকা ও ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের চেক উদ্ধার হয়। টাকার সঙ্গে লন্ডনে পলাতক একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন, হাওয়া ভবনের কর্ণধার লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের ছবি সংবলিত ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী নূর উদ্দিন অপুর নির্বাচনী লিফলেট উদ্ধার হয়। টাকার সঙ্গে ঢাকার একটি আসনের সব ভোটারের নাম-ঠিকানা সংবলিত একটি তালিকাও পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতেই গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার গ্রেফতারকৃতদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক ফারুক হোসেন। আসামিদের প্রত্যেককে ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদ উর রহমান জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিদের প্রত্যেককে পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ব্যাপারে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জব্দ হওয়ার টাকার বিষয়ে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। ঘটনাটি তারা তদন্ত শুরু করেছেন। পাশাপাশি স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি তদন্ত করছে। জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের তরফ থেকেও ঘটনাটি তদন্ত হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের বিষয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, টাকাগুলো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে ভোট কেনার জন্য ও সারাদেশে নাশকতা চালানোর জন্য দুবাই থেকে বাংলাদেশের পাঠানো হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের একজন হাওয়া ভবনে কাজ করতেন। অফিসটি থেকে শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী নূর উদ্দিন অপুর পোস্টার পাওয়া গেছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অফিসটি থেকে টাকা ছড়ানো হচ্ছে। সিটি সেন্টারের ২৭ তলায় যেখানে অভিযান চালানো হয়েছে সেখানে ইউনাইটেড কর্পোরেশন ও ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। গ্রেফতারকৃতরা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই মাস আগে অফিসটি ভাড়া নেয়। গত দুই মাসে অফিস থেকে ১৫০ কোটি টাকা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়েছে। যেসব এলাকায় টাকা পাঠানো হয়েছে, সেসব এলাকায় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এতে করে নির্বাচনে সহিংসতা ছড়াতেই টাকা পাঠানো হচ্ছে বলে স্পষ্ট হয়ে গেছে। র‌্যাব প্রধান বলছেন, ইউনাইটেড কর্পোরেশনের কথিত মালিকের এ্যাকাউন্টে গত এক মাসে ৭৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আর গত দুই মাসে এক কোটি টাকা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়েছেন তিনি। নির্বাচনকে প্রভাবিত ও প্রশ্নবিদ্ধ এবং পেশিশক্তির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতেই টাকাগুলো এখান থেকে পাঠানো হয়েছে। টাকার সঙ্গে পাওয়া প্রার্থী নূর উদ্দিন অপুর কাগজপত্র পাওয়া গেছে। ওই প্রার্থীকে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। ওই প্রার্থী শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী নূর উদ্দিন অপু। তিনি তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও এপিএস (সহকারী ব্যক্তিগত সচিব) ছিলেন। অপুর নির্বাচনী এলাকায় টাকা যাওয়ার পর নির্বাচনী সহিংসতা হয়েছে। তদন্তে জানা গেছে, যেখানে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেসব এলাকায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। শুধু এই অফিসটি থেকেই কোন দিন ১১ কোটি আবার কোন দিন ২০ কোটি টাকা ছড়ানোর তথ্য জানা গেছে। টাকাগুলোর অধিকাংশই দুবাই থেকে হুন্ডি ও ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে। দুই মাসে অফিসটি থেকে ১৫০ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এত টাকার লেনদেন হলেও অফিসের লোকজন টাকার রেকর্ড বেশি দিন রাখে না। টাকার লেনদেনের হিসাব জানতে অফিস থেকে জব্দকৃত যন্ত্রাংশগুলোর ফরেন্সিক টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। অফিসটি থেকে একটি নির্বাচনী আসনের ভোটারদের নাম, ফোন নম্বর ও ঠিকানা সংবলিত তালিকা পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভোট কেনার জন্য টাকাগুলো রাখা হয়েছিল। টাকাগুলো অবৈধ পথে উপার্জিত কালো টাকা। যারা কালো টাকা দিয়ে ভোট কিনে, তারা ক্ষমতায় এলে দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। র‌্যাব সূত্র বলছে, কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বিএনপি-জামায়াত। নেপথ্যে রয়েছেন হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমান। ওই অফিস থেকে ইতোপূর্বে বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন প্রার্থীর কাছে শত শত কোটি টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। যার কোন সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য মেলেনি। তবে গত কয়েক মাসে অফিসটি থেকে অন্তত পাঁচশ’ কোটি টাকা ছড়ানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব টাকায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী সহিংসতা চালানো হয়েছে। এসব টাকার অধিকাংশই আসছে স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসা থেকে। ইউনাইটেড কর্পোরেশনের মালিক মাহমুদুল হাসান দুবাই প্রবাসী স্বর্ণ চোরাকারবারি। পাশাপাশি তিনি বিএনপির বড় ধরনের ডোনার। আসন্ন নির্বাচনে লন্ডনে থাকা তারেক রহমানসহ বিএনপির উর্ধতন নেতাদের নির্দেশে মাহমুদুল হাসান বিএনপি প্রার্থীদের পিছনে টাকা খরচ করছে বলে জানা গেছে। মাহমুদুল হাসান স্বর্ণ চোরাচালানের একাধিক মামলার আসামি। দুবাই থেকেই চোরাচালান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। আর ইউনাইটেড কর্পোরেশনের মালিক বরিশালের ঝালকাঠি উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি। জয়নাল আবেদীন হাওয়া ভবনের কর্ণধার বর্তমানে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ। তারেক রহমানের নির্দেশে এবং সার্বিক তদারকিতেই নির্বাচনে টাকা ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে গত সোমবার শাহজাহানপুর থেকে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী মীর্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের দুই সহযোগী বিএনপি কর্মী শহীদুল ইসলাম ও মুহিতকে ভোটারদের মধ্যে টাকা ছড়ানোর সময় চার লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
×