ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোনাল্ডো-মেসিকে ছাপিয়ে সেরা মডরিচ

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

রোনাল্ডো-মেসিকে ছাপিয়ে সেরা মডরিচ

সেই ২০০৭ সালে সবশেষ ব্যালন ডি’অর ও ফিফা বর্ষসেরা হয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার কাকা। এরপর গত ১০ বছর এই গৌরবময় এ্যাওয়ার্ড দুটি জিতেছেন শুধুই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ও লিওনেল মেসি। দুজনে পাঁচবার করে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। অবশেষে দুই সুপারস্টারের দীর্ঘ রাজত্বের অবসান ঘটেছে। কাকার পর দুই তারকার বাইরে আগেই ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার লুকা মডরিচ। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন ৩৩ বছর বয়সী এ মিডফিল্ডার। এর আগে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় এবং উয়েফারও বর্ষসেরা হন মডরিচ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের আরেকটি মর্যাদার এ্যাওয়ার্ড নেন তিনি। ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আলো ঝলমলে অনুষ্ঠানে ফরাসী সাময়িকী ‘ফ্রান্স ফুটবল’ কর্তৃক দেয়া ব্যালন ডি’অর এ্যাওয়ার্ড জিতে নেন মডরিচ। গৌরময় এ পুরস্কার জয়ের পথে তিনি পেছনে ফেলেন রোনাল্ডো ও এ্যান্টোনিও গ্রিজম্যানকে। সেরা তিনে জায়গা না পাওয়া মেসি পেয়েছেন পঞ্চম স্থান। আর সেরা উদীয়মান তারকা হয়েছেন ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী সুপারস্টার কিলিয়ান এমবাপে। এ বছর রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ও জাতীয় দল ক্রোয়েশিয়ার হয়ে চোখ ধাঁধানো সাফল্যের কারণেই সব ব্যক্তিগত এ্যাওয়ার্ড নিজের শোকেসে ভরতে পেরেছেন মডরিচ। এর আগে ৩০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছিল ফ্রান্সের ফুটবল ম্যাগাজিন। এরপর ১৮০ দেশের সাংবাদিকদের দেয়া ভোটে নির্বাচিত করা হয়ে সেরা খেলোয়াড়কে। তবে অবাক করা ব্যাপার সেরা দশের মধ্যেই নেই নেইমার। ব্রাজিলিয়ান তারকা হয়েছেন ১২তম। চতুর্থ হয়েছেন বিশ্বকাপে সিলভার বল জেতা এমবাপে। রিয়ালের হয়ে গত মৌসুমে উয়েফা সুপার কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা জেতেন মডরিচ। আর রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে তুলতে বড় অবদান রাখেন। টুর্নামেন্ট জুড়ে ধারাবাহিকভাবে দারুণ খেলেন তিনি, দুটি গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে করান ১টি। জেতেন আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ‘গোল্ডেন বল’। ফিফার বর্ষসেরা ও ফ্রান্স ফুটবল সাময়িকীর ব্যালন ডি’অর পুরস্কার শুরুতে আলাদাভাবে দেয়া হতো। পরে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর দুটি পুরস্কার একীভূত করে দেয়া হয়। এরপর ২০১৬ সাল থেকে আবারও আলাদাভাবে দেয়া হচ্ছে পুরস্কার দুটি। শুধু কাকার পর জয়ের রেকর্ডই না, ব্যালন ডি’অরের ইতিহাসে মডরিচ হলেন দ্বিতীয় ফুটবলার যিনি এত বয়সে এই খেতাব জিতেছেন। এর আগে ২০০৬ বিশ্বকাপ জেতার পর ডিফেন্ডার ও ইতালিয়ান তৎকালীন অভিনায়ক ফ্যাবিও ক্যানাভারো ৩৩ বছর বয়সে এই সম্মান পেয়েছিলেন। গৌরবময় এ্যাওয়ার্ড জয়ের পর মডরিচ বলেন, শৈশবে সব শিশুরই কিছু স্বপ্ন থাকে। আমার স্বপ্ন ছিল বড় ক্লাবের হয়ে খেলব আর ভাল ভাল ট্রফি জিতব। ব্যালন ডি’অর খেতাব পাওয়াটা সেই স্বপ্নের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। এই ট্রফিটা হাতে পাওয়া একটা বিশাল সম্মান আর অধিকারের ব্যাপার। তবে মেসি-রোনাল্ডোর আধিপত্য ভাঙলেও তাদের প্রশংসা করতে ভুল করেননি ক্রোয়েট তারকা। তিনি বলেন, গত দশ বছরে এ দুজন অনেকটা অসাধারণ পর্যায়ে ছিল। অতীতে জাভি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, ওয়েসলি স্নেইডারের মতো খেলোয়াড়রা এটা জিততে পারত কিন্তু সেটা হয়নি। শেষ পর্যন্ত মানুষ, আমি জানি না, তারা অন্যকিছু চেয়েছিল। আমি মনে করি এটা (ব্যালন ডি’অর পাওয়া) ফুটবলের বিজয়। আমি খুশি যে আমি এটা জিতেছি। কিন্তু এই পুরস্কার তাদের জন্যও, যারা সম্ভবত জেতার যোগ্য হয়েও জিততে পারেনি। সাক্ষাতকারে মডরিচ আরও জানান, রোনাল্ডো-মেসির রাজত্ব ভাঙ্গতে পেরে তিনি গর্বিত। ক্রোয়েট তারকা বলেন, সবরকমের পুরস্কার- যেমন বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট; এগুলো কেউ আমাকে পেতে সাহায্য করেনি। সবকিছুই আমি কঠোর পরিশ্রমের ফলে অর্জন করেছি। মেসি-রোনাল্ডোর ১০ বছরের আধিপত্যে হানা দিয়েছেন মডরিচ। তাদের গোলের পর গোলে বিশ্ব অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত গোল করা ব্যতীত এক খেলোয়াড়কে বেছে নিয়েছে সবাই। এ প্রসঙ্গে মডরিচ বলেন, টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা, নিজের দেশকে ফাইনালে ওঠানো এগুলো সবকিছুই কল্পনাতীত ছিল। এগুলোই সবাইকে ভাবাতে বাধ্য করেছে ফুটবলটা কেবল গোল, গোল, গোলের খেলা নয়। ভাবতে ভাললাগে যে, রোনাল্ডো ও মেসির রাজত্ব ভাঙ্গতে পেরেছি। এটা খুব বেশি গর্বের। নিজের ফুটবল অধ্যায়ের শুরুর দিকে আশপাশের তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিল মডরিচকে। বিশ্বসেরা এই ফুটবলার বলেন, ছোটবেলা থেকেই সবাই আমাকে নিয়ে দ্বিধায় ছিল। শুরুর দিকে অনেক মানুষই আমাকে বিশ্বাস করতে চাইত না। সবাই আমার চারপাশে দ্বিধা নিয়ে থাকত এবং বলত আমি কখনও সেরা হতে পারব না। আমি তাদের ওসব কথায় চিন্তা করিনি। আমি আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি এবং সামনেও ছুটতে থাকব। সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্যারিয়ারজুড়ে আমি বুঝেছি যে পরিশ্রম, ধৈর্য, অধ্যবসায়, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা খুব জরুরী। আমি আহামরি কেউ না হলেও নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি একটা প্রবাদ পছন্দ করিÑ সেরা হওয়া কখনই সহজ নয়। আমার জন্য এটা সহজ ছিল না। যে সুযোগগুলো এসেছিল সেগুলো কাজে লাগানো জরুরী ছিল। আমি সেটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাক লাগানো সাফল্যের জন্য অনেকের কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মডরিচ। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিচ্ছেন সাবেক কোচ জিনেদিন জিদানকে। ফরাসী কোচের অনুপ্রেরণাতেই নাকি মাঠে তিনি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী তারকা জিদানের অধীনে রিয়ালের হয়ে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতেছেন ক্রোয়েট তারকা। তিন বছরেরও কম সময়ে ক্লাবকে ৯টি শিরোপা এনে দেয়ার পর চলতি বছরের মে মাসে গ্যালাক্টিকো শিবির ছেড়ে গেছেন ফরাসী গ্রেট। বিশ্ব ফুটবলে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জিদানের অনুপ্রেরণাকেই মূল কারণ বলে মনে করেন মডরিচ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু ঘটনা আমি কখনই ভুলব না। জিনেদিন জিদান যখন রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হলেন, একদিন অনুশীলনের পর তিনি আমাকে তার কক্ষে ডাকলেন। আমাকে একজন খেলোয়াড় হিসেবে কিভাবে দেখছেন তা তিনি বলেছিলেন। আর বলেছিলেন, আমার থেকে তিনি কি প্রত্যাশা করছিলেন। মডরিচ বলেন, তিনি বলেছিলেন, আমি তারজন্য একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। আরও বলেছিলেন যে তিনি আমাকে ভবিষ্যতের ব্যালন ডি’অর জয়ী হিসেবে দেখেন। যখন জিদানের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও ক্যারিয়ারের অধিকারী কেউ আপনাকে এমন বলে, এটা আপনাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস দেয়। আমিও সেই আত্মবিশ্বাসের পারদ পেয়েছি জিদানের কাছ থেকে।
×