ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত জয়নুল উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত জয়নুল উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ সদর দরজা পেরুতেই শোনা যায় গানের সুর। আমার হাড় কালা করলামরে, আমার দেহ কালার লাইগারে ...। শাহবাগের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় দরাজ কণ্ঠে গানটি গাইছিলেন এক চারুশিক্ষার্থী। সুরের সেই মোহময়তা ছড়িয়ে পড়ছিল বৃক্ষ আর লতা-পাতায় ভরপুর সবুজ-শ্যামল প্রাঙ্গণজুড়ে। চারপাশে দৃশ্যমান হয় চারুশিল্পীদের প্রাণের স্পন্দন। বিশাল আঙিনাজুড়ে দিনভর চলেছে জম্পেশ আড্ডা। বর্তমান চারুশিক্ষকদের সঙ্গে গল্পে মেতেছিলেন সাবেক শিক্ষকরা। আর বর্তমান চারুশিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে জমেছিল সাবেক শিক্ষার্থীদের। সেসব গল্প-আর আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সময়সহ রং-তুলির স্মৃতিমাখা পুরনো সেই দিনের কথা। সুন্দরের ছবি আঁকা এমন দৃশ্যকল্পের মাঝে শোভা বাড়িয়েছে অনুষদের লিচুতলার চারপাশজুড়ে চলমান জয়নুল মেলা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চিত্রিত চিত্রকর্মসহ সে মেলায় ঠাঁই পেয়েছে শোলার পুতুল, নক্সীকাঁথা, টেপা পুতুল, শীতলপাটি, কাঠের হাতিসহ কত কিছু! আলাদা করে নজর কেড়েছে জয়নুল গ্যালারি। এই প্রদর্শনালয়ে দেখা মিলেছে অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের বার্ষিক প্রদর্শনীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত চারুশিক্ষার্থীদের শিল্পকর্মে সাজানো প্রদর্শনী। এমন উৎসবমুখরতায় মিশেছিল শুধুই ভাললাগার অনুভব। এভাবেই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিল জয়নুল উৎসবে। মঙ্গলবার সূচনা হওয়া পাঁচ দিনব্যাপী এ উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চারুকলার ৭০ বছর পূর্তির আয়োজন। দেশের শিল্পকলার পথ প্রদর্শক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন উপলক্ষে এ উৎসবের আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। মঙ্গলবার ভোরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত চারুকলা অনুষদের প্রথম ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল এবং অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ারুল হকের সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে শুরু হয় উৎসব কার্যক্রম। এরপর সকালে অনুষদের পার্শ্ববর্তী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়াল কামরুল হাসান ও শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদের সমাধিতে অর্পণ করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে চারুকলা প্রাঙ্গণে বর্ণিল বেলুন উড়িয়ে উৎসব উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে অনুষদ থেকে বের হয় শোভাযাত্রা। নানা রং ও অবয়বের মুখোশের সঙ্গে শোভাযাত্রার সঙ্গী ছিল জয়নুল আবেদিনসহ অনুষদের আটটি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতিকৃতি, রাজা-রানীর মুখোশ, ফুল, চরকিসহ নানা অনুষঙ্গ। শোভাযাত্রায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. মুহাম্মদ সামাদ, চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, শিল্পাচার্যের পুত্র প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন, অনুষদের শিক্ষক ও বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী, প্রখ্যাত চিত্রকর মনিরুল ইসলামসহ অনেকে। দেশের আন্দোলন-সংগ্রামে চারুকলার ভূমিকাটি তুলে ধরে অনুষদের ডিন নিসার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানের এই চারুকলা অনুষদে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনায় শিল্পকে হাতিয়ার করে লড়াই করেছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। এ কারণেই আমরা শিল্পী কোন ইস্যু নিয়ে রাস্তায় নামলে সাধারণ মানুষ আমাদের বিশ্বাস ও সমর্থন করে। প্রগতিশীল চেতনার লড়াইয়ের শিল্পীরা কাজ করেছে নিঃস্বার্থভাবে। নিজেরা কি পেলামÑএই ভাবনার বদলে দেশকে কিছু দেয়ার প্রবণতাই তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের মানসিকতায়। উৎসবের প্রথম দিন সকাল থেকে রাত অবধি চারুকলার বকুলতলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে অনুষদের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পরিবেশনার পাশাপাশি এই মঞ্চে স্মৃতিচারণ পর্বে অংশ নেন বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার ও আনোয়ার হোসেন। সাংস্কৃতিক পর্বে সেতারে সুমধুর সুর ছড়িয়েছেন আলিফ লায়লা। প্রদর্শিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্র। পৌষের সন্ধ্যায় গানে গানে উৎসব আগন্তুকদের হৃদয় রাঙিয়েছে সঙ্গীতদল জলের গান। জয়নুল মেলায় অংশ নিয়েছে অঙ্কন ও চিত্রায়ন, ভাস্কর্য, প্রাচ্যকলা, মৃৎশিল্পসহ অনুষদের আটটি বিভাগ। সেখানে বিক্রি হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আঁকা চিত্রকর্ম থেকে শুরু করে সরাচিত্র, টেপা পুতুল, ধাতব গহনা, চিত্রিত বর্ষপঞ্জিসহ নানা কিছু। এছাড়ায় মেলায় ঠাঁই পেয়েছে শাঁখারিবাজারের শঙ্খশিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি, যশোরের নক্সীকাঁথা, ঝিনাইদহের শোলাশিল্প, ধামরাইয়ের ধাতবশিল্প, মৌলভীবাজারের শীতলপাটি, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি ও সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুলের স্টল। অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের বার্ষিক শিল্পকম প্রদর্শনীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত চারুশিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ১ ও ২ নং জয়নুল গ্যালারিতে সাজানো সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ২৩ ডিসেম্বর থেকে। চলবে উৎসবের শেষ দিন ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে জয়নুল উৎসব ও জয়নুল মেলা। আগামী ২৯ ডিসেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন। এদিন জয়নুল উৎসবের সমাপনী দিন। সমাপনী দিনের সকালের আয়োজনে প্রদান করা জয়নুল সম্মাননা। শিল্পাচার্যের জন্মদিনে বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর মাধ্যমে নিয়মিতভাবে জয়নুল উৎসবের সূচনা হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। ডিন নিসার হোসেন জানান, শুরুর দিকে ছাত্ররাই এই আয়োজন করত। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে বৃদ্ধি এ উৎসবের কলেবর।
×