ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেরানীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রুহিতপুরী লুঙ্গি বিলুপ্তির পথে

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

কেরানীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রুহিতপুরী লুঙ্গি বিলুপ্তির পথে

সালাহ্উদ্দিন মিয়া, কেরানীগঞ্জ ॥ কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরী লুঙ্গি ঐতিহ্যের আদিকাল থেকে গ্রাম্য বাংলার অবসর সময়ের আরামদায়ক পোশাক। সারা বাংলাদেশে এক নামেই পরিচিতি রয়েছে এই রুহিতপুরী লুঙ্গির। রুহিতপুরী লুঙ্গির শুরুর কথা বলতে গেলেই কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা ও রুহিতপুর এলাকা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে। ধীরে ধীরে এই লুঙ্গি এখান থেকেই ছেয়ে গেছে দোহর-নবাবগঞ্জ, নরসিংদী, বাবুর হাট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। সরকারী সুযোগ-সুবিধা তেমন না থাকায় উদ্যোগ দাতারাও এ তাঁত শিল্প থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। ফলে কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরী লুঙ্গির তাঁত শিল্পগুলো বিলুপ্তির পথে, কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দা-রুহিতপুর গ্রামের রুহিতপুরী লুঙ্গির তাঁতগুলোর খট খট শব্দ এক সময় আশপাশের কয়েক গ্রামে শোনা যেত। এক সময় এই অঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার তাঁত শিল্প ছিল। প্রায় লক্ষাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখানকার রুহিতপুরী লুঙ্গির তাঁত শিল্প মৃত প্রায়। মেশিন নয়, রুহিতপুরী তাঁতের লুঙ্গি সম্পূর্ণ নিখুঁত হস্ত শিল্প। প্রতিটা মানুষের নিখুঁত শ্রম, সুনিপুণ কাজ ও নানান কস্টসহ কত ধরনের উপকরণ, সময় ও রীতিনীতি মেনেই তৈরি হচ্ছে একেকটা বাহারি, টেকসই ও মজবুত লুঙ্গি। প্রতি দেড় দিনে তৈরি হয় এক থান লুঙ্গি অর্থাৎ চারটা, যার পারিশ্রমিক আসে পাঁচশত টাকা। বংশ পরম্পরায় পাওয়া এ তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করেই এই অঞ্চলে অন্য কাজ না জানা মানুষ ও কর্মহীন মানুষের বেকার সমস্যা সমাধানসহ জীবিকা নির্বাহ ও আয়ের উৎসের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। মহিলারাও সংসারের কাজের অবসরে এই তাঁতগুলোতে কাজ করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাবে। স্বল্পমূল্যে মানসম্মত রুহিতপুরী লুঙ্গি পাওয়া যায় বলেই দেশের সর্বত্র এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রুহিতপুরী লুঙ্গির তাঁত শিল্পের উদ্যোগদাতারা এমনটাই আশা করছে, সরকার তাঁতীদের প্রয়োজনীয় পুঁজি ও সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র সহজলভ্য দিলে কেরানীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রুহিতপুরী লুঙ্গির তাঁত শিল্পকে বিলুপ্তির পথ থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে তার আদি গৌরব। রামেকান্দা-রুহিতপুর তাঁত শিল্পের একজন তাঁতী জনকণ্ঠকে জানান, ২০-২৫ বছর যাবত তাঁত দিয়ে লুঙ্গি তৈরির কাজ করছি, মাঝে বেশ কয়েকবছর বন্ধ ছিল। তখন একেক জন একেক ধরনের কাজে চলে যাই। এখন আবার তাঁত শুরু হওয়াতে ভালই আছি। চারটা লুঙ্গিতে ২০০ টাকার মতো লাভ থাকে। এক থান লুঙ্গি বুনতে দেড় দিন লাগে। আগে ছিলাম বেকার এখন তাঁতে কাজ করে ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছি। তাঁতে কাজ করে এক বছরে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। বাবুর হাট থেকে আসা এক ক্রেতার কাছে জানতে চাইলে তিনি এমনটাই বলেন, রুহিতপুরী লুঙ্গির মান ভাল, সুতা ভাল, রং পাকা, পরতেও আরাম আর চাহিদা বেশি থাকায় আমরা রুহিতপুরী লুঙ্গি এখান থেকে কিনে নিয়ে বিক্রি করি। রুহিতপুরী লুঙ্গি বিক্রি করে লাভও বেশি হয়। শরীফ লুঙ্গি ও রামেরকান্দা-রুহিতপুর তাঁত শিল্পের পরিচালক ও উদ্যোগতা মোঃ শরীফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা জাতিগতভাবেই তাঁতী। পূর্বপুরুষ থেকেই রুহিতপুরী লুঙ্গির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এলাকার গরিব তাঁতী ও বেকারদের নিয়ে নিজ উদ্যোগে একটি কারখানা করি। রুহিতপুরী লুঙ্গির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সরকার যদি তাঁতীদের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেয় তাহলে রুহিতপুরী লুঙ্গির তাঁতও বাড়বে এবং ব্যবসাও ব্যাপক আকারে করা যাবে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মোঃ ফখরুল আশরাফ বলেন, ২০-২৫ বছর আগে থেকেই রুহিতপুর ইউনিয়কে সারা বাংলাদেশ চিনে কারণ এখানে একটি প্রসিদ্ধ শিল্প গড়ে উঠেছে রুহিতপুরের প্লাকার্ড লুঙ্গি। এখানে যে তাঁতী সমাজটা আছে তার দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে খুব ভাল লুঙ্গি তৈরি করত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করত। আজকে তাঁতীদের পুঁজির অভাবে এবং সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এ শিল্প থেকে সরে গেছে। সমাজসেবা অধিদফতরের ম্যাধমেও কিছু গ্রাম কমিটি গঠন করে তাঁতীদের উজ্জীবিত করা হচ্ছে।
×