ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম এ কাশেম

অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ॥ জনগণই মুখ্য

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ॥ জনগণই মুখ্য

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে। নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ পুরোদমে নেমে পড়েছে, বিএনপিসহ বিরোধী দলও ধীরে ধীরে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যজোটের ২৫ ডিসেম্বর থেকে সমস্ত শক্তি (জনবল-অর্থবল) নিয়ে সর্বাত্মকভাবে নির্বাচনী প্রচার এবং ভোট ব্যবস্থাপনায় নামার কথা। পত্রিকায় প্রকাশ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশের নির্বাচনে পুরোদমে তৎপরতা শুরু করেছে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয়ের পরিস্থিতি শেষ মাত্র ৩ দিনে উল্টে ফেলা হয়। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেমন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে জনগণের মাঝেও। গ্রামেগঞ্জের হাটে-বাজারে-চায়ের দোকানে, তেমনি শহরাঞ্চলের অফিস-আদালতে, বাসে-ট্রেনে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা শহরের জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা হয়তো ভাবি যে, আমরা যা বলি গ্রামের লোকজন বা সাধারণ লোকজন সেটাই বোঝেন। বিষয়টা আদৌ তা নয়। তাদের আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক শুনলে বোঝা যায় তাদের রাজনৈতিক চিন্তা এবং মেধা কত উন্নত! মূলত অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, সকল দলের জন্য একই ধরনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, প্রার্থীদের গুণাগুণ, কোন্ প্রার্থীর বা দলের জয়ের সম্ভাবনা বেশি- এসব নিয়েই সাধারণ মানুষের আলোচনা। ইদানীং বিরোধীদলীয় কোন কোন নেতার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য শুনে বিগত কয়েক দিন ধরে প্রশ্ন উঠেছে- ‘নির্বাচন’ হবে তো?’ তাদের আলোচনা নিয়েই আমার বর্তমান নিবন্ধ। সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়– সকলের অংশগ্রহণমূলক বলতে কার বা কাদের অংশগ্রহণের কথা বলা হচ্ছে? কোন বিশেষ রাজনৈতিক দল বা দলের, না জোটের, না কি জনগণের? রাজনৈতিক দল বা জোটের অংশগ্রহণ অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টিই মুখ্য। কারণ, রাজনৈতিক দল বা জোট সঙ্কীর্ণ দলীয় কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে ভুল সিদ্ধান্তের বশবর্তী হয়ে (যেমনটা বিএনপি হয়েছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনে), অথবা কোন বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যদি অংশগ্রহণ না করে, কিন্তু জনগণ নির্বাচনে (ভোট প্রদানে) অংশগ্রহণ করেন, তাহলে কি এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে না? অবশ্যই এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে। তবে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, শতকরা ২৫-৩০ ভাগ ভোটার ভোট দিলে সেটাকে কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে? এরকম অবস্থা হতে পারে কেবল যদি ২০১৪ সালের মতো ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে বা ফেরার পথে রাস্তা কেটে, গাছ ফেলে, আগুন জ্বালিয়ে, হায় হাঙ্গামা করে ভোটারদের ভোট দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকে বৈধ বলে ঘোষণা করতে হবে। কারণ, তা না হলে ভবিষ্যতে নির্বাচনকালে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নস্যাৎ করা এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণতন্ত্রবিরোধী, জাতীয় স্বার্থবিরোধী, ষড়যন্ত্রের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশের বন্ধু এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক সম্প্রদায়কে এটা বোঝাতে হবে। গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে- নির্বাচন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হতে হবে, কিন্তু কাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে- জনগণের কাছে, না- নির্বাচন বর্জনকারী দল বা জোটের কাছে? না- বিদেশী মুরব্বিদের কাছে? এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি যে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতাÑ সে কথা তেমন জোর দিয়ে বলা হচ্ছে না। এমন কি যারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলে প্রচার চালায়, তারাও জনগণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন না। তাদের উচিত এ ব্যাপারে ধূ¤্রজাল সৃষ্টি না করে জনগণকে পরিষ্কার ধারণা দেয়া। একথা ঠিক যে, যদি গ্রহণযোগ্যতার অজুহাতে সঙ্কীর্ণ দলীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বা বানচাল করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। এবার আসা যাক নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এর কথায়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটি শুনতে বেশ আকর্ষণীয়। আগের দুটো বিষয়ের মতো এ বিষয়টিও সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যায়িত হয়নি। ফলে এই বিষয়টি সম্পর্কে যে যার মতো করেই বুঝে নিচ্ছে। সাধারণভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে লোকের ধারণা- সকলের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার, ভোটের জন্য প্রচার চালানোর অধিকার, শান্তি এবং নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রভাবমুক্ত রাখা এবং ভোট প্রদানের জন্য শান্তি এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভোট গণনায় কারচুপি না হওয়া, নির্বাচনী ব্যয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে সবিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন মূলত দলীয় নির্বাচনী প্রচারে কোনরূপ বাধা প্রদান না করা এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থী, নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার না করার ওপর। একথা সত্যি যে, রাজনৈতিক কারণে কোন প্রার্থী, নেতা, কর্মীকে গ্রেফতার করা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিরোধী। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী ‘যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন চান না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের তালিকাও চেয়েছেন। তবে তা সঠিকভাবে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিরোধী দল বা জোট কি করছে সেটা জনগণকে অবহিত করতে হবে। শুধু অভিযোগ করলেই জনগণ তা গ্রহণ করবে না। এছাড়া সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কেসের আসামি এবং পলাতক আসামিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়, বিশেষ করে রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান দুর্বৃত্তায়ন রোধ করতে হলে। কয়েক দিন আগে টকশোতে একজন গুণী ব্যক্তি বললেন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ কোন দেশে এমনকি গণতন্ত্র চর্চার জন্য খ্যাত আমেরিকা বা ইংল্যান্ডেও বর্তমান সময়ে থাকে না- আমাদের দেশে তো কখনোই না - কোন আমলেই না- বিষয়টা হলো মাত্রার- কম আর বেশি– কখনও বেশি বেশি। জেনারেল জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ - না ভোটের সময়ও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ছিল না , এরশাদের আমলেও ছিল না, বিএনপির আমলে মাগুরার নির্বাচনেও ছিল না। আওয়ামী লীগ কেন, আজ সরকারে বিএনপি, ২০ দলীয় জোট, ঐক্যফ্রন্ট কিংবা যুক্তফ্রন্ট থাকলেও, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হতো বলে জনগণ মনে করে না। যে নির্বাচন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, সে নির্বাচনে কোন দল বা জোট আমলেই আদর্শ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আশা করা যায় না। কাজেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা দলীয় সমর্থক ছাড়া দেশের সাধারণ ভোটার কিংবা দেশী বা ‘বিদেশী তো বটেই’ - নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মনে আবেদন বা আবেগ সৃষ্টি করে বলে মনে হয় না। আমি বিদেশীদের সঙ্গে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করেছি। তাদের ভাবনা চিন্তা কিছুটা বুঝতে পারি। এখন প্রশ্ন, তাহলে কি যা খুশি তাই হবে? না, তা হবে না। বিষয়টা একটা সহনীয় পর্যায়ের মধ্যে থাকতে হবে। সহনীয় পর্যায়ের সীমারেখা যখন অতিক্রম হয়, তখন মাগুরার নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলনের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। সহনীয় পর্যায়ের সীমারেখা জনগণই ঠিক করে নেয়। এটা আমাদের দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ- পার্শ্ববর্তী ভারতের নির্বাচনেও আক্ষরিক অর্থে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই থাকে না। প্রকৃতপক্ষে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা কোথাও আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্র কিংবা- আমাদের বিরোধীদলীয় দল বা জোট যেভাবে বলছেন, সেভাবে-লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না, তবে সহনীয় পর্যায়ে থাকে। সহনীয় পর্যায় মাত্রা একেক দেশের একেক রকম, ওই দেশের জনগণের চিন্তা চেতনা ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। পরিশেষে, আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলাফলের ওপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন, আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার ভবিষ্যত, এমনকি সন্ত্রাসবাদ সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের ভবিষ্যত নির্ভরশীল। আজও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দেশকে পরিচালিত করার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী এবং মদদপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ও গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র চলছে। জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ যথার্থ প্রার্থীর পাশে দাঁড়াতে হবে। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ
×