ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

ভিন্নধর্মী উদ্যোগে সফল তান্নু

প্রকাশিত: ০৭:২০, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ভিন্নধর্মী উদ্যোগে সফল তান্নু

বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা যেখানে নারী সেখানে নারীকে বাদ দিয়ে এই পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কথাটি পুরোপুরি সত্য। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান দিন দিন বাড়ছে। আজ নারী ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে, নানা প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি সমান তালেই। নারী আজ শুধু চাকরিই নয়, উদ্যোগী হচ্ছে নানা স্বাধীন ব্যবসায়। ঠিক তেমনি একজন সিলেটের মেয়ে সৈয়দা খাদিজা আক্তার তান্নু। বিবিএ ও এমবিএ করা এক তরুণী। বলা চলে এক সাহসী উদ্যোক্তা। যিনি নিজ উদ্যোগে সিলেটের টিলাগড়ে গড়েছেন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘চাটবাজ’। যা আজ সিলেটের জনপ্রিয় চাট খাবারের একটি জায়গা। তান্নু সিলেটে তরুণ-তরুণীদের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। চাট মূলত ইন্ডিয়ার একটি জনপ্রিয় খাবার যা আমাদের দেশে ফুচকা, চটপটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তান্নু তার প্রতিষ্ঠানে এই গতানুগতিক ধারা ভেঙ্গেছেন। সিলেটবাসীকে দিয়েছেন রাজকাচুড়ি থেকে শুরু করে দই বড়াচাটসহ বিভিন্ন আইটেমের স্বাদ। প্রায় প্রতি মাসেই তান্নু তার আয়োজনে যোগ করেন নতুন নতুন সব চাট। তার এই উদ্যোগটি কিন্তু ইট বালু দিয়ে তৈরি কোন দোকান থেকে শুরু নয়। শুরুটা নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, এক ধরনের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও নতুন কিছু করার ইচ্ছাটাই বেশি ছিল। সামাজিক দায়বদ্ধতা দুটির প্রথমটি হচ্ছে, হাইজেনিক স্ট্রিট ফুড প্রায় নেই বললেই চলে, আর এই অস্বাস্থ্যকর খাবারটি খেয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাচ্চারা। এদের কথা চিন্তা করেই চাটবাজের শুরু আর শেষেরটি আরও বড় কারণ ‘ছোট পুঁজিতে ব্যবসা, বড় স্বপ্নের আশা’ এই মতবাদ নিয়ে কাজ করা। সাধারণত সিলেটে সবাই চায় চাকরি অথবা বড় বা মাঝারি পুঁজির ব্যবসা করতে। যা না পেয়ে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন বা কোন না কোনভাবে রাষ্ট্রকে দোষারোপ করেন। তান্নু তার চাটবাজ দিয়ে ওই সব যুবশক্তিকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে, ছোট পুঁজিও হতে পারে বড় কিছু করার চালিকাশক্তি। কর্মসংস্থান তৈরি করাটা এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে খুবই জরুরী। এখানে যে শুধু কর্মসংস্থান করা হয় তা না, প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয় অল্পশিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক যারা পরবর্তীতে শুরু করেছে নিজেদের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা। চাটবাজ থেকে প্রশিক্ষিত ২৫ জনের মতো জনশক্তি যারা এখন নিজেদের ফুচকা, পুরি বা শেল, নিমকি, কিংবা মসলার কারখানা দিয়ে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। শুরুটা যতটুক চ্যালেঞ্জিং ছিল টিকে থাকাটা ছিল আরও কঠিন। রক্ষণশীল সামাজিক ব্যবস্থায় একজন সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ও বউ নারী উদ্যোক্তা হয়ে রাস্তায় ব্যবসা করবে তা অনেকেই মেনে নেয়নি। তার জন্য তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে এমন কি কথা শুনতে হয়েছে তার স্বামীকেও। মানুষ আসলেই খুব সহজে একে অন্যকে অপমান করে ফেলে। তবে এর চেয়ে বেশি ছিল মানুষের প্রশংসা যা এই সবকিছুকে কাটিয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা যোগায়। সঙ্গে প্রবল মনোবল ও শিক্ষা একটা বিশেষ সাপোর্ট দিয়েছিল। তার পরিবারও তাকে বিশেষভাবে সাপোর্ট করে এই বিষয়ে। আজ অনেকেই আসেন তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে। তরুণ উদ্যোক্তারা এখন এগিয়ে আসছে ছোট পুঁজি নিয়ে, সিলেট শহরে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। তার এই অবদানকে স্বীকৃতী দিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও ব্রিটিশ হাইকমিশন তাদের ইউমেন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড (ডড়ড)-এর মাধ্যমে, ইনসপায়ারিং স্টোরিতে তান্নু ও চাটবাজ সম্পর্কে তুলে ধরে তাদের সিলেট চ্যাপ্টারে। কথা বলে জানা যায়, তান্নু চাকরি পেয়েছিলেন ব্র্যাক, আড়ং ছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে, কিন্তু ব্যবসা তাকে সব সময় টানত। মানবসম্পদ প্লেসমেন্টের ব্যবসাও করেছেন অনেকদিন ঙ২ শরঃবং নামে। কিন্তু রান্না তাকে বেশি টেনেছে, এই ব্যবসায় মূলধন বেশি লাগে তাই ২০১৬ সালে নিজের জন্মদিনে পাওয়া কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন তার ঈযধধঃ ইুুঁ (চাটবাজ) হাইজিন ইন স্ট্রিট স্লোগান নিয়ে। বর্তমানে ১২ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিন সময় দেন তার স্বপ্নের দোকানটিতে। নিজের রন্ধনশৈলীকে কাজে লাগিয়ে আজ তৈরি করছেন বিভিন্ন খাবার। ভাল লাগে যখন বাচ্চাদের নিয়ে মা-বাবারা আসেন চাট খাওয়াতে। মনে হয় তিনি মানুষের হাইজিন নিয়ে চিন্তা অনেক খানি গোছাতে পেরেছেন। সমাজের প্রতিটা মেয়ে একদিন সৎপথে আয় করুক স্বাবলম্বী হয়ে মাথা উঁচু করে থাকুক। একদিন এই দেশ উন্নত হবে এই আশা তার। আজ তার স্বামীও তার ১২ বছরের কর্পোরেট চাকরি জীবন বাদ দিয়ে তার সঙ্গে ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন। তান্নুর ভবিষ্যত পরিকল্পনায় আছে সেফ ও হাইজেনিক স্ট্রিট ফুড নিয়ে বর্তমান ছোট ছোট ভেন্ডারদের স্বল্প খরচে কোন কোন ক্ষেত্রে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং বিশাল জনশক্তির এই কর্মধারাকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে তুলে ধরা। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তান্নু।
×