ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

পরিবর্তনের নায়ক আজায়ি আকিনফোলারিন

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

পরিবর্তনের নায়ক আজায়ি আকিনফোলারিন

শ্যারন ওকপোয়ে তার ১৭ বছরের জীবনের সবটাই কাটিয়েছেন মাকোকোতে। নাইজিরিয়ার লাগোসের লেগুনে নির্মিত মাকাকো পরিচিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভাসমান বস্তি হিসেবে। সারিসারি নড়বড়ে ঝুপরিঘর দাঁড়িয়ে আছে দূষিত পানিতে। সরু খাল বেয়ে চলাচলের একমাত্র বাহন ক্যানু। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শহরের পাশে তাদের কোনমতে বেঁচে থাকা। লাগোস শহরটির অর্থনীতি তেল, বিদেশী বিনিয়োগ আর শিল্প-কারখানার কারণে সমৃদ্ধ। এ মুহূর্তে লাগোসকে বলা হচ্ছে নাইজিরিয়ার সিলিকন ভেলি। বছরের শুরুতে ফেসবুক, গুগুল তাদের অফিস খুলেছে সেখানে। অনুমান করা হয় শহরের একুশ মিলিয়ন অধিবাসীর দুই-তৃতীয়াংশই বাস করেন বস্তিতে। ‘আমি যখন প্রথম মাকোকোতে পা রাখি, সেখানকার মানুষের কষ্টের জীবন দেখে আমি বিস্মিত হই। বেশিরভাগ মেয়েই দারিদ্র্যের চক্রে আবদ্ধ। না আছে শিক্ষার সুযোগ, না ভবিষ্যত পরিকল্পনা।’ লাগোসের কম্পিউটার প্রোগ্রামার আজায়ি-আকিনফোলারিন এভাবেই স্মরণ করছিলেন নিজের অভিজ্ঞতা। এখন কিছুটা হলেও সেখানকার মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পার্লস আফ্রিকা ফাউন্ডেশনের গার্লসকোডিং তাদের সুযোগ করে দিয়েছে নতুন এক জীবনে প্রবেশের। ২০১২ থেকে পরিচালিত এই প্রোগ্রামে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক সুবিধাবঞ্চিত নারী বদলে নিয়েছে তাদের ভাগ্য। এ প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা ৩৩ বছরের তরুণী আজায়ি। স্বপ্ন বাস্তবায়নে যিনি বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সফল ক্যারিয়ার। টেকনোলজি সেক্টরে পুরুষের তুলনায় নারীর অপ্রতুল উপস্থিতি তাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি এ বৈষম্য ঘোচাতে চেয়েছেন। তার ভাষায় টেকনোলজির ক্ষেত্রটিতে এখনও পুরুষরাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। কিস্তু আমরা কেন তাদের জায়গা ছেড়ে দেব। আমি বিশ্বাস করি মেয়েরা পারে, প্রয়োজন কেবল সুযোগের। আজ স্কুল শেষে ১০-১৭ বছরের মেয়েরা তার প্রতিষ্ঠানে এইচটিএমএল, সিএসএস, জাভাস্ক্রিপ্ট, পাইথন এবং স্ক্র্যাচের ট্রেনিং নিচ্ছে। এখানে যে কেবল বস্তি থেকে আসা মেয়েরা আছেন তা নয়। এতিমখানা, সংশোধনাগার এমনকি বোকো হারামের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা মেয়েরাও আছেন। আজিয়ার বিশ্বাস এদের মাঝ থেকে উঠে আসবে সমাজ বদলে দেয়া প্রতিভা। প্রয়োজন তাদের জন্য জীবন দেখার সুযোগ সৃষ্টির। তিনি যে কেবল তার মেয়েদের টেক কোম্পানিগুলো পরিদর্শনের সুযোগ করে দেন তাই নয়, তাদের মনে স্বপ্ন বুনে দেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দেয়ার। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওকপোয়ে তৈরি করেছেন একটি এ্যাপ নাম মাকোকো ফ্রেশ। যে এ্যাপের মাধ্যমে স্থানীয় জেলেরা সরাসরি তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবেন ক্রেতার কাছে। ওকপোয়ে আজ স্বপ্ন দেখেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, আশা একদিন হার্ভার্ডে পড়তে যাবেন। আজায়ি তার মেয়েদের প্রায়ই বলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ সেটি ভুলে যাও। বিশ্বাস রাখ তোমরা পারবে। তোমরা কোডার, তোমরা চিন্তাশীল মানুষ। তোমাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে আজিয়া বলেন জীবন আমার জন্য ছিল কঠিন মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারাই, বাবার পিটুনি ছিল নিত্যসঙ্গী। শৈশব থেকেই আমি বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শিখেছি। কম্পিউটারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১০ বছর বয়সে স্কুলের অবসরে। সেখানে টাইপ করা আর মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে টেক্সট মডিফাই করা আমাকে রীতিমতো জাদু করে। তবে আমি কম্পিউটারের প্রেমে পড়ি হাই স্কুল শেষে একটি কম্পিউটার ফার্মে ইনটার্ন করার সময়। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের জগতটাকে আমার মনে হয়েছিল খুব চেনা। বিষয়টি ছিল কেবল সমস্যা সমাধান করার। তবে একদিন আমি নিজেই সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের সমস্যা সমাধানে লেগে যাব এটা তখনও ভাবিনি। আজায়ি চান মেয়েদের চিন্তা ধারায় পরিবর্তন। তার গার্লস কোডিংয়ের মূল উদ্দেশ্য সেটাই। তার ইচ্ছা মেয়েরা নেতৃত্ব দেবে, হয়ে উঠবে পরিবর্তনের নায়ক। আমরা যেমন একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোডিং করি তেমনি দৃশ্যমান সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করব। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন ‘হোপ বাস্কেট’ নামে একটি প্রকল্পের কথা। মেয়েরা চেয়েছিল সড়কগুলো ভিক্ষুকমুক্ত করতে। তাই তারা ধনী ও দরিদ্রদের সেতুবন্ধন তৈরি করতে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে যেখানে কেউ তার প্রয়োজনের কথা জানাবে, আর ইচ্ছুক সাহায্যদাতা তাকে খুঁজে নিয়ে করতে পারবে প্রয়োজনীয় সাহায্য। এই সাহায্য দলগতভাবেও করা সম্ভব। আরেকটি প্রকল্প ‘ব্রেক দ্য ব্লেড’ যেখানে মেয়েদের নিষ্ঠুর খতনা প্রথা বা হয়রানি থেকে প্রতিকার লাভ সম্ভব। অমানবিক খতনা প্রথা নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে তারা কথা বলতে চায়। এমন কী তারা একটি রিস্ট ব্যান্ড প্রচলন করতে চাইছে এফজিএম-এর শিকার হতে যাওয়া কোন নারী যার বাটনে চাপ দিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা পাবেন। বিষয়টি কেবল কোডিং নয়। মেয়েরা যখন নিজ থেকে সমস্যা সমাধান করতে শিখবে সেটি তাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই সাহস জোগাবে। নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে আজায়ি বলেন, আমরা আমাদের কর্মসূচী নাইজেরিয়ার অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আশা করি একদিন গড়ে তুলব গার্লস ভিলেজ, যেখানে মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। আমি তাদের জন্য এমন একটা সুযোগ তৈরি করে দিতে চাই যে, তারা নিজেরাই সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে। কোডিংয়ের সমস্যা সমাধান করতে করতে একদিন আমরা হয়ত আরও বড় সমস্যা সমাধান করতে শিখব। আজায়ির ভাষায়, মেয়েরা কেবল প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হয়ে থাকবে না। তারা হবে স্রষ্টা। অনেকেই বলেন, নিজের পেশায় লেগে থাকলে আমি অঢেল অর্থ উপার্জন করতে পারতাম। বোকার মতো আমি পেশা ত্যাগ করেছি। হয়ত তারা ঠিক। কিন্তু আজ যখন আমি, জীবনে কম্পিউটার ছুঁয়ে দেখেনি এমন মেয়েদের দেখি কোডিং করতে। তাদের চোখমুখে যে আনন্দ তা তো অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব ছিল না। আজায়ি আজ নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিজের দেশে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের ভাগ্য বদলে। তার কাজ তাকে ঠাঁই দিয়েছে বিবিসির ২০১৮, ১০০ নারীর তালিকায়। সিএনএন তাকে বলছে- নায়ক।
×