ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব অর্থনৈতিক কূটনীতিকে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব অর্থনৈতিক কূটনীতিকে

এম শাহজাহান ॥ বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হলে পণ্য ও জনশক্তি রফতানি বাড়বে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি আসবে বড় অঙ্কের রেমিটেন্স। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান। একইভাবে দেশীয় উদ্যোক্তারাও বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন। ইসরাইল ব্যতীত জাতিসংঘের প্রায় সকল সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্র ও মাদক ছাড়া সব ধরনের পণ্য আমদানি ও রফতানির সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। এদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার। দলটির বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন বিস্ময় হিসেবে দেখা দিয়েছে। উন্নয়ন দর্শন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে রূপকল্প-২১। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সময়েই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দেবে জাতিসংঘ। এমডিজির পর জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে স্থায়ীত্ব উন্নয়নেও বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম সারিতে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ বাস্তবমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করবে। শুধু তাই নয়, ২১০০ সালের মধ্যে নিরাপদ বদ্বীপ গড়তে গ্রহণ করা হয়েছে ডেল্টা প্ল্যান। বাংলাদেশের উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির বাইরেও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত হতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব চুক্তিতে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে নেগোসিয়েশনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়া শ্রম অধিকার রক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, সুশাসনের নিশ্চয়তাসহ আন্তর্জাতিক মান ও চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়ার ওপর তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার মূলত একটি উন্নয়ন দর্শন। এই উন্নয়ন দর্শনে সারাবিশ্বকে যুক্ত করার একটি কৌশল রয়েছে আওয়ামী লীগের। পোশাক, চামড়া ও প্লাস্টিকের পাশাপাশি অসংখ্য প্রডাক্ট বাংলাদেশ রফতানি করছে। রফতানি বাড়াতে হলে অর্থনৈতিক কূটনীতি একটি বড় বিষয়। তিনি বলেন, রেমিটেন্স অর্জনে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে শুল্ক-অশুল্ক জনিত অনেক বিষয় জড়িত। যেহেতু উৎপাদন বাড়ছে এ কারণে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করাও একটি বড় দায়িত্ব। অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার হলে এসব বিষয়ের সহজ সমাধান করা সম্ভব। এদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতিগ্রস্ত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র, অকার্যকর রাষ্ট্র প্রভৃতি কলঙ্ক ঘুচিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ^ দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় স্বার্থে তাই অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূখ-ে জঙ্গীবাদ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কোন শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শ ও সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বিধিবদ্ধ নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর আলোকে সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের এক বিরাট মাইলফলক। দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করে ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও ছিটমহল হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সীমান্ত মীমাংসা সাম্প্রতিক বিশে^ উদাহরণ স্থাপন করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে মোট ১১১টি ছিটমহলে ১৭,১৬০.৬৩ একর জমি বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে বহুমুখী সহযোগিতা জোরদার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বহুমুখীকরণ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সার্ক, বিমসটেক ডি-৮, আসিয়ান রিজিওনাল ফোরাম (এআরএফ), এশিয়া কো-অপারেশন, এশিয়া-ইউরোপ মিটিংসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল ফোরামে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখা হয়েছে। রাশিয়া ও চীনসহ আসিয়ানভুক্ত দেশের সঙ্গে আমাদের বহুমুখী সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত। এছাড়া ২০১১ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও শান্তির জন্য ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন মডেল’ সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। একই বছর বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত শান্তির সংস্কৃতি প্রস্তাবটি পাস হয়। কূটনৈতিক কার্যক্রমের প্রসারে ২১টি মিশন ও সাবমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের এসব পদক্ষেপে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য এক কাক্সিক্ষত গন্তব্যস্থল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে রাজনৈতিক কূটনীতির চেয়ে এখন অর্থনৈতিক কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেশের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মোঃ সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদর্শীসম্পন্ন মানুষ। তিনি বাস্তবতার নিরিখেই এটা করেছেন। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। কেন এই উন্নয়ন? কারণ, সঠিক নেতৃত্ব। ব্যবসায়ীরা সারা বিশ্বে পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন। শ্রমিক ভাইরা বিশ্ব থেকে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনৈতিক কূটনীতির কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং উৎপাদন ও ২০২১ সালের মধ্যে রফতানি ৬০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে হলে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সমন্বয় সাধন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে রাজনীতির সমন্বয় সাধন বেশ কঠিন একটি কাজ। অর্থনৈতিক কূটনীতির চর্চা এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বহুপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদারীকরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ করা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার হলে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি বাজার সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।
×