ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী

বড়দিন ও আমাদের বিশেষ প্রার্থনা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

বড়দিন ও আমাদের বিশেষ প্রার্থনা

আজ শুভ বড়দিন! ঈশ্বর ধর্মময় বলেই বড়দিন। পবিত্র বাইবেলে ঈশ্বরের প্রেমের বিষয়টির চেয়ে অনেক বেশিবার উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরের ধার্মিকতার কথা। ‘ঈশ্বরের ধার্মিকতা’র দ্বারা মূলত বোঝানো হয় ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণতাকে। তার সঙ্গে আছে তাঁর সিদ্ধতা, বিশ্বস্ততা, পবিত্রতা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি। ঈশ্বর অনন্ত অসীম প্রেমময়। তবে ঈশ্বরের শর্তহীন প্রেম বলে কোন কথা বাইবেলে নেই। ঈশ্বর ন্যায়বান বলেই পাপের দ- আছে। পাপ ও অপবিত্রতার সঙ্গে স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী ঈশ্বরের কোন আপোস নেই। তাঁর প্রেম ও অনুগ্রহ পেতে হলে মানুষকে অনুতাপসহ মন পরিবর্তন করে তাঁর দিকে ফিরে আসতে হবে। পাপ তথা শয়তানের হাত থেকে মানুষ ও সমস্ত সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করার জন্য যিশু মানবরূপে এ জগতে এসেছেন। তাঁর মধ্যে যে প্রেম প্রকাশিত, ঈশ্বরের সে প্রেমের পশ্চাতে আছে তাঁর ধার্মিকতা। ঈশ্বরের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি অবশ্যই পাপের দ- দেবেন। খ্রিস্টের ক্রুশীয় মৃত্যু সে কারণেই হয়েছিল। খ্রিস্টের জন্মে প্রকাশিত স্বর্গীয় প্রেমের মর্মমূলে আছে পাপের প্রতি পবিত্র ঈশ্বরের ঘৃণা এবং স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী ঈশ্বরের ন্যায়বিচার। তাই বড়দিনে পাপী মানুষের জন্য স্বর্গীয় প্রেমের প্রকাশ দেখি। খ্রিস্টের ক্রুশীয় মৃত্যুতে প্রকাশিত তাঁর ধার্মিকতা ও ন্যায়বিচারের আলোকে আমরা দেখি। পাপীর স্থলে তার সমুচিত দ- খ্রিস্ট ভোগ করেছেন; তাতে সরল বিশ্বাসে পাপী লাভ করে পরিত্রাণ। তাঁর দ্বারা পাপী মানুষ পাপের দ-মুক্ত হয়, আর ন্যায়বিচারও রক্ষা প্রতিষ্ঠিত থাকে। এভাবেই খ্রিস্টের আত্মদানের মাধ্যমে মন্দের বশে চলে যাওয়া মানুষ স্রষ্টা ও মঙ্গলময় ঈশ্বরের সঙ্গে সম্মিলিত হতে পারে। খ্রিস্ট যখন বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মতুল্য প্রেম কর।’ তার অর্থ আমরা যেন সকল মানুষকেই যথাসাধ্য ভালবাসা ও সম্মান করতে চেষ্টা করি। মানবহিতৈষী এই চিন্তা আমাদের নিজেদের পরিবারে ও সমাজের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। দুস্থ, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলা, কাজ করা সব ধর্মেরই শিক্ষা। যিশু খ্রিস্ট আমাদের বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতায় সে শিক্ষা ব্যবহার করতে তাঁর আত্মদানের মধ্য দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা ছিল সেদিনের সমাজে প্রচলিত শিক্ষার চেয়ে স্বতন্ত্র ও জীবনমুখী। তাঁর সময়ে প্রচলিত একটি কথা ছিল, ‘তুমি যে ব্যবহার অন্যের কাছ থেকে চাও না, সেরূপ ব্যবহার অন্যকে দিও না।’ এই না-বোধক কথার স্থলে যিশু বললেন, ‘তুমি অন্যের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেতে আশা কর, প্রথমে তুমি অন্যকে সে ব্যবহার দেও।’ এ বছরে পবিত্র বড়দিনের উপাসনায় বাংলাদেশের প্রায় ১৩ লাখ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী স্বর্গীয় পিতার কাছে প্রার্থনার অর্ঘ নিবেদন করবে। আমাদের একান্ত প্রার্থনা হবে যেন ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় দেশের একাদশ সংসদের নির্বাচন নির্বিঘœ, সুষ্ঠু ও অবাধ হয়। দেশের সর্বত্র যেন শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন এবং সারাদেশে নির্বাচন সংক্রান্ত সকল কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল মানুষ যেন তাদের পবিত্র দায়িত্বসমূহ যে কোন প্রকারের পক্ষপাতিত্বের উর্ধে থেকে পালন করতে পারেন। আমাদের অন্তরের প্রার্থনা যেন সংশ্লিষ্ট সকল নেতাদের, সংসদ সদস্যপদ প্রার্থীগণ নির্বাচন সংক্রান্ত সকল বিধিমালাকে মান্য করেন। ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রাণের প্রার্থনা যেন সত্যিকারে দেশপ্রেমী, সৎ, ন্যায়বান ব্যক্তিরা আমাদের সাংসদরূপে সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হন। আমাদের সকলের জানা ভাল এ কথা যে, অনেক বৈষয়িক উন্নতি ও ধন-দৌলতের চেয়ে এ দেশের সর্বসাধারণ মানুষের প্রাণের প্রথম চাহিদা শান্তিময় এক জীবন এবং ন্যায়ের সমাজ ও জীবনের মান-সম্মানের নিরাপত্তা। আমাদের আরও প্রার্থনা যেন আামদের দেশ সম্পূর্ণ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশরূপে তার অস্তিত্বকে বজায় রাখতে পারে। আমাদের এ সুন্দর মাতৃভূমি হোক এমন একটি দেশ যেখানে ধর্ম-বর্ণ, গোত্র ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে সকলের সঙ্গে সম্প্রীতি, একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ ও ন্যায্যতার মূল্যবোধে বসবাস করতে পারবে। বড়দিনকে ঘিরে থাকা মানবসৃষ্ট প্রথা বা সকল বাহ্যিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার উর্ধে উঠে খ্রিস্টের ন্যায্যতা, প্রেম ও মানব সেবার আদর্শে চলার জন্য আজ আমাদের জীবনে তৈরি হোক বড় এক মাইলফলক! লেখক : খ্রিস্টীয় পুরোহিত ও খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক, সমাজকর্মী
×