ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমার গ্রাম আমার শহর- আমাদের দায়িত্ব

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

আমার গ্রাম আমার শহর- আমাদের দায়িত্ব

জব চার্নক ১৬৯০ সালে কলকাতায় সুবেদার ইব্রাহিম খানের সঙ্গে সমঝোতা করে সুতানটি গ্রামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপন করেন। তারও নয় বছর পরে জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে দানপত্র নিয়ে কলকাতা ও গোবিন্দপুরসহ সুতানটি মিলিয়ে কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন করেন চার্ণকের জামাতা চার্লস আয়ার। এরও অন্তত বছর ত্রিশেক আগে থেকে সুবেদার শায়েস্তা খানের আমলেই ঢাকা একটি শহরের সুবিধাসম্পন্ন মর্যাদা পায়। মূলত শায়েস্তা খানই ঢাকাকে স্থানীয় বাণিজ্য, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান। তাঁর কল্যাণে ঢাকা একটি ছোট দাফতরিক কেন্দ্র থেকে বৃহৎ ও উন্নত শহরে পরিণত হয়। পরে ব্রিটিশ রাজত্বে আধুনিক কল্যাণ শহরের বৈশিষ্ট্যগুলো ঢাকায় ফুটে উঠে। ইতিহাসে এসব ঘটনাবলীর পারম্পর্যে বাংলায় শহর পত্তনের সমুদয় বিবরণ পাওয়া গেলেও শহর কেমন করে গ্রাম থেকে আলাদা হয়ে গেল তার ঐতিহাসিক তথ্য বিশেষ একটা আলাপ হয় না। যা হয় তা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের, পরিবর্তনের সূত্র নিয়ে নয়। অনেকটাই উত্তম কুমারের সিনেমার সংলাপের মতো, ‘থাক না হয় আজ, পরে একদিন সব বলা যাবে’! এই করে করে আমাদের শহরের ইতিহাস প্রায় চার শ’ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। শাসনকার্যের জন্য যে একটি স্থাপনা-আয়োজন ভিন দেশীদের নিজেদের জন্য একদিন তৈরি করতে হয়েছিল তা কালে কালে শাসন ও শোষণের মূলবিন্দু হয়ে গেল। মাপের দিক থেকে, জনসংখ্যার দিক থেকে তা শতকরা ২০ ভাগও ছাড়িয়ে যেতে পারল না। কিন্তু ৮০ ভাগের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল এই শহর। যদি বাংলাদেশের কথাই ধরি, মাত্র আশি-নব্বই বছর আগে যে কৃষকের সন্তান পাজামা আর হাওয়াই শার্ট গায়ে দিয়ে আর রাবারের চপ্পল পরে শহরে পড়তে এসেছিল, অন্যের বাসায় ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে তার বিনিময়ে খাওয়া-দাওয়া ও রাতে এক চিলতে চৌকিতে শুয়ে ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে তিনি একদিন একটা চাকরি পেয়েই সাহেব হয়ে গেলেন! নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য ছেলেমেয়েদের জন্য নানা রকম বাজার-ঘাট, স্কুল-কলেজের সুবিধার আয়োজন করে দেখুন এই ঢাকা শহরই সদরঘাট থেকে ছাড়িয়ে কেমন করে ষাটের দশকে ধানক্ষেত দখল করে আবাসিক এলাকা বানিয়ে নিল! এদের কোন ঐতিহ্য চিন্তা ছিল না, ফলে সেই সম্রাট জাহাঙ্গীর বা শায়েস্তা খান থেকে শুরু করে আজও পর্যন্ত যেসব স্থাপনার ইতিহাস মূল্য বেশি সেগুলো নিমেষে ধ্বংস করে শহর বাড়াতে তাঁদের বিবেকে সামান্য দংশনও হয়নি। এদের কান্ডজ্ঞানের কত অভাব ছিল তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। নগর পরিকল্পনায় কোন ভবিষ্যতের চিন্তা তো দূরের কথা, রাস্তা বা বাড়িগুলোর নম্বর কেমন করে দিতে হবে সে জ্ঞানও অর্জন করার আগেই এরা হয়ে উঠেছিল সবকিছুর নিয়ামক শক্তি। আপনি একবার লালমাটিয়া বা গুলশানে যান, দেখবেন একটা ঠিকানা খুঁজে পেতে কী পরিমাণ হয়রানি হতে হয়! এই ধানমন্ডি তো সেদিন, একটা ‘এ’ জুড়ে দিয়ে রাস্তাগুলোর বিভাজন চিহ্নিত করতে পেরেছে। এই সাহেবরা পঞ্চাশের দশক থেকে দলে দলে বিলেত যেতে শুরু করলেন, এদের কেউ কেউ সঙ্গে করে নিয়ে এলেন একজন গৌরবর্ণের স্ত্রী আর একটা মোটরগাড়ি। কিন্তু দেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখল, এখনও দেখে, সে সঙ্গে করে বিলেতে থেকে যা যা শিখেছিল তা সবই ফেলে এসেছে ফলে মোটরগাড়ি চালাবার যে নিয়ম তাকে বিলেতে মেনে চলতে হয়েছে দেশে ফিরে তিনি নীরব। কারণ তিনি এখানে সাহেব, কম কথা বলতে হবে। গ্রাম থেকে ধরে এনে কৃষকের বেকার ছেলেদের গাড়ি চালাতে চাবিটা দিলেন ঠিকই কিন্তু সঙ্গে নিয়মটা দিলেন না, ফলে রাস্তা-ঘাটজুড়ে শুরু হলো অরাজকতা যা আজও চলছে। যারা সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের ব্যর্থতার দায় আজ পুরো জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। না হলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কেন এক নম্বরে এটা লিখতে হয়েছে যে ‘আমার গ্রাম হবে আমার শহর’? কারণ ওইসব শহুরেরা এই ব্যবধানের উটকো ঝামেলা বাধিয়ে দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যেতে সামান্য বাকি রেখেছেন। না হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একশ’ একটা কাজ আছে যেগুলো করে দিয়ে তিনি দেশটাকে সোনায় মুড়িয়ে দিতে পারতেন। এখন আমরা যে ঝামেলা সৃষ্টি করেছি তিনি সে অনাসৃষ্টি থেকে আমাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছেন। আমরা বুঝি প্রশাসন চালাতে একটা ব্যবস্থা লাগে আর সে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকতে একটা উপায় লাগে। কিন্তু যাদের জন্য এই প্রশাসনিক আয়োজন সেইসব মানুষ যে সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি সেটা আমরা ভুলে থাকি কেমন করে? কারণ, এই তথাকথিত শহর আমাদের স্বার্থপর করেছে। আমরা আর কোনদিন গ্রামে ফিরে যাইনি। গ্রামে বাবা-মা-ভাই-বোন-দাদা-দাদি-নানা-নানি-খালা-ফুফু সবাই থাকে কিন্তু এক ব্যস্ত অজুহাত আমরা তৈরি করে নিয়েছি কারণ আমরা শহরের লোক, গ্রামের মানুষ পিছিয়ে আছে, আমরা এগিয়ে। ফলে ওদের সঙ্গে আর আমাদের মিলছে না। বৈষম্যের জন্ম এই স্বার্থবুদ্ধি আর বিচ্ছিন্ন থাকার চিন্তা থেকেই। আমরা আবার একে নাম দিয়েছি স্বাতন্ত্র্যবাদ! ফরাসী শিল্পকলা দর্শন থেকে আসা অস্তিত্ববাদের প্রভাবে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার মধ্যে লুকিয়ে ফেলার ফ্যাশন তৈরি করেছি কিন্তু বোকার দল আমরা বুঝতে পারছি না যে, ইউরোপে অনেক আগেই গ্রামগুলো শহরের সুবিধা নিয়ে ফেলতে পেরেছে ফলে তাঁদের দার্শনিক যুক্তি আর আমাদের যুক্তি কখনও মিলবে না। আমাদের এই মানসিক বৈষম্যের বিকারের সঙ্গে যোগ হয়েছে শিক্ষা। বিলেত থেকে আমাদের নব্য সাহেবরা যে শিক্ষা শিখে এসেছেন তার কানাকড়িও বিলি বণ্টন করতে পারেননি। তাহলে শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে তারা ভাবতেও কাজ করতেন। তিনি যখন কূপির আলোয় ওপরের ক্লাসের ভাইবোনের ধার করা বই পড়তেন ও মক্তবে বা টোলে যা শিখতেন সেখানে একটা মূল্যবোধের চেতনা ছিল। এরা শহরের পণ্ডিত হয়ে নিজেদের জীবন থেকে ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সব মূল্যবোধ ঝেড়ে ফেলে দিলেন। না হলে অঙ্ক বইয়ের সূত্র ব্যাখ্যা করতে লিখেন কেমন করে দুধে ভেজাল মেশাতে হয়? আমাদের গ্রাম বাংলার যে সংস্কৃতি তাঁকে তারা বলেই দিলেন লোক অর্থাৎ অ-লোক বা শহুরে বলে আর একটা সংস্কৃতি আমাদের আছে। তারা সেসবের পৃষ্ঠপোষক। তাকিয়ে দেখুন বেশিরভাগ মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখানে তারা লোকের গান শুনলে কেমন বেহুশ হয়ে যায়, আর আপনার চেঁচামেচির গান শুনে কেমন মুখ বাকা করে নেয়। কার জোর তাহলে বেশি হবে? শহরের না গ্রামের? গ্রামের-ই বেশি হবার কথা কিন্তু ক্ষমতার জোরে আমাদের নিজেদের আরবান কালচার বলে এক নতুন আধা খেঁচড়া সংস্কৃতির আমরা জন্ম দিয়ে বসে আছি। আর বাকি থাকে দায়িত্ববোধ। সেটা তো ওইদিন গ্রাম থেকে এসেই খেয়ে বসেছি। চিন্তা করে দেখুন, আমাদের প্রত্যেকের একটা গ্রাম আছে, কিন্তু সেই গ্রামের জন্য আমরা কী করেছি? আমি প্রমাণ দিয়ে বলতে পারি বাংলাদেশের অনেক গ্রামে স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। ছেলেদেরটা বেশিরভাগ-ই খোলা সেখানে মেয়েরা যেতে চায় না বা পারে না। আশপাশের বাড়িতে যায় ও বকা খায়। একটা টয়লেট করে দিতে কত টাকা লাগে? এটা কি সরকারকেই করে দিতে হবে? এই যে আমরা এত নামী-দামী মানুষ নিজের গ্রামের স্কুলে একটা টয়লেট বানাতে সাহায্য করি না কেন? আপনি-আমি এত নামকরা মানুষ, বছরে একবার গ্রামের স্কুলে যেয়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করেছেন- আপনি কত বড় মানুষ হয়েছেন আর কেমন করে হয়েছেন? তাহলেও তো সে গর্ব করত আমাদের গ্রামের একজন আছেন অনেক নামকরা। এই গর্বটাও আপনারা কেন করতে দেন না? বাংলাদেশের সরকারের কল্যাণে গ্রামাঞ্চলের অনেক উন্নতি হয়েছে কিন্তু এদেশের গ্রাম থেকেই আসা সবাই, যারা সেসব উন্নতির অনেকটাই শেয়ার করতে পারেন তাদের সম্পৃক্ত করা দরকার। প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। আপনি অনেক টাকার মালিক, অনেক ক্ষমতা আপনার, কল-কারখানার মালিক কিন্তু যেই দেশের মানুষ টাকার অভাবে মেয়েটার বিয়ে দিতে পারে না, ছেলেটার চাকরি বাকরি নেই বলে হতাশায় বাড়ি থেকে বের হয় না, বখে যাচ্ছে, তার জন্য আপানার আমার দায়িত্ব অনেক বেশি। আপনার বড়লোকি কিছুতেই টিকে থাকবে না যদি ভোটের সময় যেয়ে ভোট চান আর সারা বছর আপনার দরজায় এলে বকা-ঝকা খেয়ে ফিরে যেতে হয়। কী করবেন সে চিন্তা আপনাকেই করতে হবে, সরকার এত চিন্তা করতে পারবে না। সরকার শুধু বিষয়গুলো চিহ্নিত করে দেবে আপনি-আমি মিলে সেসব ঠিক করে দেব। যারা ভাবছেন গ্রামে গ্রামে এখন শহরের মতো বসুন্ধরা বা যমুনা ফিউচার পার্কের মতো শপিংমল হবে তারা ভুল ভাবছেন। গ্রাম গ্রামের মতোই থাকবে সেখানে শুধু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেগুলো আমি আপনি শহরে বসে যুগ যুগ ধরে স্বার্থপরের মতো ভোগ করেছি সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হবে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভাল করে লেখাপড়া করতে পারবে, কম্পিউটার চালাবে, ইন্টারনেট চালাবে আর দুনিয়ার সব খবর তাদের হাতের মুঠোয় রাখবে। কেমন করে বাড়ির অভাব তাড়াতে হবে সে নিজেই তার সুরাহা করে নিতে পারবে, দুনিয়ার কোথায় কার সঙ্গে কোন কাজে কখন যোগাযোগ করতে হবে সে জানবে। সে জানবে কখন তাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে কোথায় নিয়ে যেতে হবে, কখন নিতে হবে। গ্রামগুলোতে কেউ অকালে মারা যাবে না, বিনা চিকিৎসায় কেউ মরবে না বা ধুকে ধুকে বেঁচে থাকবে না। গ্রামের মানুষ নিজেদের মতো করে স্বপ্ন দেখবে ও অন্যদের স্বপ্ন দেখাবে। তাদের ঘরবাড়িগুলো হবে তাঁদের মতো করে বানানো। তাঁদের পথঘাট হবে নিরাপদ ও দুর্ঘটনাহীন। গাছগুলো মাথা উঁচু করে থাকবে যুগের পর যুগ, যখন তখন এগুলো কেউ কেটে নিতে পারবে না। কৃষক যে ফসল জন্মাবে তার ন্যায্য দাম তিনি পাবেন, বাজারের দর থাকবে তাঁদের কাছে সহনশীল। শখ পূরণে কোন বোন মন খারাপ করে বসে থাকবে না বা কোন ভাই দরজা বন্ধ করে বিনা কাজে শুয়ে বসে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করবে না। গ্রামের মানুষ এখনও যেমন অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তখন, যখন তাঁদের সব পাওয়া হবে তখনও তাঁদের সেই সম্মান করে জীবন চালাবার মনোবল থাকবে। শহরের টাউট-বাটপার-প্রতারকদের এরা গ্রামে ঘাঁটি গাড়তে দেবে না। এমনকি নিজেদের গানগুলোও গাইবে নিজেদের মতো করেই। উৎসব পার্বণ পালন করবে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সবাই মিলেই, কেউ তাঁদের দোজখের ভয় দেখিয়ে আলাদা করতে পারবে না। শুধু আমাদের তখন বুঝতে হবে কার কী দায়িত্ব কখন পালন করতে হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×