ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়ন

আমাদের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রধানত নগরকেন্দ্রিক। আরও সঠিকভাবে বলতে হয়, রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। এর অনিবার্য পরিণতি এই হয়েছে যে, দেশের সব মানুষ, এমনকি প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলের মানুষও কোন না কোন কারণে ঢাকামুখী হতে বাধ্য হয়। নিছক জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেও মানুষ ছোটে ঢাকায়। ফলে ইতোমধ্যেই জনসংখ্যার ভারে রীতিমতো ভারাক্রান্ত ঢাকায় প্রতিদিনই মানুষের চাপ বাড়ছে। অথচ প্রায় শুরু থেকেই ঢাকা একটি অপরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সংযুক্ত হয়েছে নতুন নতুন অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। সত্যি বলতে কি, ঢাকা এর মধ্যেই আকার-আকৃতি-আয়তন ও শ্রীবৃদ্ধিতে একটি বেঢপ শহরের মর্যাদা পেয়েছে। বৈশ্বিক বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায়ও দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে ঢাকা। প্রথম স্থান অধিকার করে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক। রাজধানী ঢাকার আবাসন, যোগাযোগ, পানি-বিদ্যুত-গ্যাস সংযোগ, পয়ঃসংযোগ ও পয়ঃনিষ্কাশন, পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রায় সবই শ্রীহীন ও অপরিকল্পিত, সর্বোপরি ক্ষয়িষ্ণু। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, যানজট, জনজট, জলজট, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, হাট-বাজার-জনস্বাস্থ্য প্রায় সবই ভেঙ্গে পড়েছে বলা চলে। এর প্রধান কারণ একেবারেই পরিকল্পনাহীন ও যথেচ্ছ উন্নয়ন। রাজধানীর বাইরে দ্বিতীয় নগর বন্দর ও বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামের অবস্থাও যে ভাল, এমন বলা যাবে না কিছুতেই। অথচ পাহাড়-টিলা-গাছপালা-সমুদ্র অধ্যুষিত চট্টগ্রামের সম্ভাবনা ছিল বিস্তর। অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী উন্নয়নের ফলে চট্টগ্রামের চেহারা বর্তমানে বিবর্ণ, শ্রীহীন। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা তো ইতোমধ্যেই ঠাঁই পেয়েছে বৈশ্বিক তালিকায়। এমন আশঙ্কাও আছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য প্রভাবে এক সময় তলিয়েও যেতে পারে বন্দর ও বাণিজ্য নগরীটি। এর বাইরে অন্যান্য বিভাগীয় নগর রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লার অবস্থা কি আদৌ ভাল? এর উত্তরও সার্বিক বিবেচনায় নেতিবাচক হতে বাধ্য। বাকি থাকল উপজেলা সদরগুলো। গত কয়েক বছরে ব্যাপক আর্থিক উন্নয়নের ফলে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে উপজেলা সদরসহ অনেক গ্রাম-গঞ্জ ও ইউনিয়নের। পোশাক শিল্প ও প্রবাসী আয়ের ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের আয়-উপার্জন বেড়েছে বহুলাংশে। প্রায় গ্রামেরই এক বা একাধিক ব্যক্তি প্রবাসে থেকে আয়-উপার্জন করে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে থাকে দেশে ও গ্রামের বাড়িতে। সেখানেও খুব দ্রুতই গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি, বিলাসবহুল কটেজ এমনকি ক্ষুদ্রশিল্পসহ কল-কারখানা। স্বীকার করতে হবে যে, এসবই উন্নয়নের শুভ লক্ষণ। তবে প্রায় সবই পরিকল্পনাবিহীন ও শ্রীহীন। যেমন চারদিকে কৃষিক্ষেত অথবা জলাভূমি, মাঝখানে একটি চার-পাঁচতলা সুদৃশ্য ইমারত। এটিকে কি আমরা আদৌ উন্নয়ন বলব? নিশ্চয়ই নয়। এর জন্যই আজকাল নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও বাস্তুসংস্থানবিদরা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন, সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা ও উন্নয়নের ওপর। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার যে অবস্থা, অথবা চট্টগ্রাম ও বিভাগীয় নগরগুলোর তাতে করে আধুনিক ডিজিটাল নগর তথা আবাসন গড়ে তোলার সম্ভব নয়। কেননা, এসবই এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। পরিকল্পনাবিদদের মতে, বর্তমানে দেশের ৩০ শতাংশ লোক বসবাস করে শহরে। ২০৪০ সাল নাগাদ জনসংখ্যার অর্ধেক লোক বসবাস করবে শহরে। অতঃপর বিদ্যমান শহরগুলোর পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন করতে গেলে লোকজন সরাতে হবে। ভেঙ্গে নতুন করে গড়তে হবে সবকিছু। বাস্তবে তা কখনোই সম্ভব নয়। সেজন্য এখন চোখ ফেরানোর সময় এসেছে উপজেলা পর্যায়ে। প্রতিটি উপজেলায় গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ। কেননা, সেখানেও ভাল করেই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। সে অবস্থায় যত্রতত্র আবাসন, যততত্র স্থাপনা ও কলকারখানা না করে স্থানীয় জনসংখ্যা ও চাহিদার প্রেক্ষাপটে নিতে হবে সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন পরিকল্পনা। আর তাহলেই কেবল সম্ভব একটি আধুনিক ও ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ।
×