ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মান্দার জিঁউ মন্দির

প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন, হতে পারে পর্যটনকেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন, হতে পারে পর্যটনকেন্দ্র

বিশ্বজিৎ মনি ॥ ‘পুন্ড্র জনপদের অন্যতম প্রাচীন জনপদ হিসেবে নওগাঁর ঠাকুরমান্দার ঐতিহাসিক পরিচিতি রয়েছে। পাল আমলের বিভিন্ন প্রত্ন নিদর্শন এই জনপদ থেকে আবিষ্কৃত হয়। বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে ওইসব সম্পদ। জনপদটিতে রয়েছে হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবে প্রাচীন শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিঁউ মন্দির। মন্দিরটি ঘিরে প্রতিবছর চৈত্র মাসে রাম নবমীর মেলা বসে। তখন ৯ দিনব্যাপী হিন্দু পুণ্যার্থীসহ লাখো মানুষের ঢল নামে এই জনপদে। উৎসব চলে অন্তত ১৫দিন। প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম এই জনপদটি নওগাঁর মান্দা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক। প্রাচীন এই জনপদের নামেই মান্দা উপজেলার নাম পরিচয় হয়। ইংরেজ আমলে মান্দা থানা পুলিশ স্টেশনও ছিল এখানেই। ভৌগোলিক অবস্থান ॥ নওগাঁর মান্দা উপজেলা সদর প্রসাদপুর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহাসিক ঠাকুরমান্দা জনপদ। আত্রাই নদীর অন্যতম শাখা শিবনদ ও বিলমান্দার পশ্চিম তীরে জনপদটির অবস্থান। বর্ষাকালে শিবনদের পূর্ব তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে দাঁড়ালে জনপদটি অথৈ পানিতে ভাসা একটি দ্বীপ বলে মনে হয়। জনপদটি নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার ও রাজশাহী থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ‘রাজখাড়া’ জমিদারি এস্টেটের কাচারি বাড়ির ভগ্নাবশেষ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রঘুনাথ জিঁউ মন্দিরের পাশে। প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৭৮০ সালে নাটোরের মহীয়সী রানী ভবানী মান্দার এই রঘুনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। এর গঠন পিরামিডাকৃতির। মন্দিরের সম্মুখে ডরিক স্তম্ভবিশিষ্ট অর্ধবৃত্তাকার বারান্দা আছে। মন্দিরটি সপ্তদশ শতকের হলেও এর অভ্যন্তরে স্থাপিত বিগ্রহগুলো আরও অনেক পুরনো। এই বিগ্রহগুলো প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে নানামত রয়েছে। কেউ বলেন, মান্দার বিল খননকালে রাম, লক্ষণ, সীতা ও রামভক্ত হনুমানের বিগ্রহগুলো পেয়ে ওই মন্দিরে স্থাপন করা হয়। কিংবদন্তি রয়েছে, ওই গ্রামে বাস করতেন এক দরিদ্র অন্ধ ব্রাহ্মণ। তিনি অতীব রামভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বিলে স্থান করতে যান। সেখানে স্থানে নামলে বিগ্রহগুলো বিলের পানিতে ভাসতে ভাসতে এসে তার শরীরে স্পর্শ হয়। তখন তিনি প্রণাম করে মূর্তিগুলো মাথায় ও কোলে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করেন। সেখানে প্রতিদিন ৩ বেলা পূজা-অর্চনা করতে শুরু করেন। এক পর্যায় তিনি দৃষ্টি ফিরে পান এবং সাংসারিক সচ্ছলতা ফিরে পান। তখন থেকেই রঘুনাথের মাহাত্ম্যের কথা চারদিকে প্রচার হতে থাকে। বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়। এক পর্যায় প্রভুর মাহাত্ম্যের কথা পৌঁছে নাটোরের রানী ভবানীর কানে। তিনি ঠাকুর মান্দায় পৌঁছে মন্দিরের জীর্ণতা দেখে নিজেই মন্দির তৈরি করে দেন। শাহী স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে স্থাপিত এই মন্দির। আবারও শোনা যায়, প্রাচীন এই মন্দিরে ‘মানদা দেবী’ নামে এক সেবায়েত ছিলেন বলেও শোনা যায়। তাকে নিয়েও রয়েছে কিংবদন্তির কথা। জানা যায়, মানদা দেবী কোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে স্পর্শ করলে তিনি দৃষ্টি ফিরে পেতেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, কিংবদন্তির এই ‘মানদা’ দেবীর নামেই এই জনপদের নাম ‘মান্দা’ হয়ে থাকতে পারে। তবে ‘মান্দা জনপদ’ হিসেবে জনপদটি পরিচিত হলেও বাস্তবে এখানে মান্দা নামে কোন গ্রাম বা মৌজা নেই। মন্দিরের ধর্মানুষ্ঠান ॥ প্রতিবছর চৈত্র মাসে রামের জন্ম তিথিতে মন্দিরে বিশেষ পূজা-অর্চনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ৯ দিন ধরে চলে এ পূজা-অর্চনা। তখন সারাদেশ এমনকি ভারত থেকেও আসেন হিন্দু পুণ্যার্থীরা। গঙ্গাস্নান করে তারা পূজা দেন রঘুবীরের চরণে। সকল ধর্ম-বর্ণের লাখো মানুষের ঢল নামে এ উৎসবকে ঘিরে। পুণ্যার্থীরা একসময় মন্দিরের চারপাশের বিল ও শিব নদীতে গঙ্গাস্নান করে ভেজা কাপড়ে বিল থেকে পদ্মপাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেত ঠাকুর দর্শন করতে। ভক্তরা আজও সেই রীতি-নীতি মানতে চান। কিন্তু চৈত্রের নদী ও বিলে এখন আর পানি থাকে না। তাই মন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভেজা কাপড়ে পূজা দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভুর চরণে নিবেদন করে থাকেন। অনেকে সপ্তাহব্যাপী মন্দিরের পাশের মাঠে তাঁবু গেড়েও অবস্থান করেন। অনেকে থাকেন ৯দিন ধরে। ভক্তবৃন্দের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে রাতে পদাবলী কীর্তনেরও আসর বসানো হয়। মন্দিরটিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রাম নবমীর উৎসব এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সর্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে। ঠাকুর মান্দার এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও দেশ-বিদেশে পরিচিতি রয়েছে। তাই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংলগ্ন স্থানে একটি মোটেল গড়ে তুলতে পারলে দূরের পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত হতো। এতে মন্দির চত্বরে পর্যটকদের যেমন ভিড় বাড়ত, পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ত। এলাকার সচেতন মহল ঠিক এমনটাই দাবি করছেন।
×