ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি প্রবাসী কিছুসংখ্যক বাংলাদেশী শনাক্ত ॥ গ্রেফতার করে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের জন্য সৌদি সরকারকে চিঠি

ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা ॥ জামায়াত শিবিরসহ দেশী বিদেশী চক্র জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা ॥ জামায়াত শিবিরসহ দেশী বিদেশী চক্র জড়িত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নির্বাচনের আগে ও পরে পরিকল্পিতভাবে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। মূলত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটাতেই এমন তৎপরতা চালানো হচ্ছে। পুরো এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির। দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকেও গুজব ছড়ানোর কাজ চলছে। এমন তৎপরতায় অর্থায়নে জড়িত দেশী-বিদেশী চক্র। সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে থাকা বেশ কিছু বাংলাদেশী এমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। যাদের মধ্যে সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সৌদি আরব সরকারকে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। ওইসব বাংলাদেশীর ওয়ার্ক পারমিট (কাজ করার অনুমতি) বাতিলসহ তাদের সৌদি আরব থেকে গ্রেফতার করে সরাসরি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে ওই চিঠিতে। নির্বাচনের আগে ও পরে ফেসবুক মনিটরিং করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটে বিশেষ সেল খোলা হয়েছে। সেলগুলো ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করাসহ তাদের দ্রæত গ্রেফতার করতে অভিযান চালিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাবের চালানো অভিযানে ঢাকা থেকে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত তিন যুবক গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের তৎপরতার বিষয়টি। নির্বাচনের আগে ও পরে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হতে পারে। গুজব ছড়িয়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। দেশের সাধারণ মানুষকে নির্বাচন সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে মারমুখী করে তোলার চেষ্টা করছে তারা। অনেক দিন ধরে তারা দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে গুজব ছড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। যাদের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকেও নিয়মিত ফেসুবক মনিটরিং করা হচ্ছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, এবারের নির্বাচনে গুজব ছড়ানোর বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এজন্য সিআইডিতে ফেসবুক মনিটরিং করার জন্য পৃথক একটি সেল খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত অনেকেই গ্রেফতারও হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য মোতাবেক দেশের ভেতর এবং বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়। যার অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। পুরো এই প্রক্রিয়াটির সঙ্গে বিদেশে থাকা অনেক বাংলাদেশী জড়িত। যার মধ্যে সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা বেশি। এরা শুধু নিজেরাই ফেসবুকে গুজব ছড়ায় না, গুজব ছড়ানোর কাজে অর্থায়নও করে থাকে। সৌদি আরব প্রবাসী এমন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশীকে শনাক্ত করা হয়েছে। যারা ইতোপূর্বে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ নানা ইস্যুতে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত। তাদের বিষয়ে সৌদি আবর সরকারের দূতাবাসে চিঠি দেয়া হয়েছে। সৌদি আরব সরকারকে ওইসব বাংলাদেশীর ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের সৌদি আরবে গ্রেফতার করার কথাও বলা হয়েছে। গ্রেফতারের পর তাদের বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য নিয়মিত সৌদি আরব সরকারের সঙ্গে যোগাযোগও রাখা হচ্ছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশীদের পুরো ঠিকানা যোগাড় করা হয়েছে। তাদের পরিবারসহ অনেকের বিষয়ে খোঁজখবরও নেয়া হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি তাদের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতা বিরোধীরা শুধু ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তারা রীতিমত বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট হুবহু নকল বানিয়ে সেইসব মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর সঙ্গেও জড়িত। দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা নজরদারি চলছিল। শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের ২৮ নবেম্বর এমন গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত কামাল হোসেনকে (২৩) মোহাম্মদপুর থেকে এবং গাজীপুরের টঙ্গী থেকে মোঃ আল আমিন (৩০) নামের দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ছাত্র শিবিরের সদস্য। গ্রেফতারকৃত আল আমিন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিএসই (কম্পিউটার সাইন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) ছাত্র। আর কামাল কুমিল্লা নওয়াব ফয়েজুন্নেছা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিবিএ (ব্যবস্থাপনা বিভাগ) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তারা নির্বাচন সামনে রেখে অনলাইনে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের সুনাম ক্ষুণœ করার চেষ্টা করছিল। চলতি বছরের আগস্টে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়িয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা নির্বাচন সামনে রেখে গত কয়েক মাস ধরে প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন, বিবিসি বাংলার মতো বিভিন্ন নিউজ পোর্টালের আদলে বেশ কিছু ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছিল। তিনি আরও জানান, গত ৭ আগস্ট র‌্যাব শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর দায়ে ধানমন্ডি থেকে আকতারুজ্জামান টনি (২২), আসাদুল্লাহ আল গালিব (২২) ও মুনইম সরকার (২৩) নামে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা ছাত্র শিবিরের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারা ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট ছবি, গুজব, বানোয়াট ভিডিও ছেড়ে দিয়ে আন্দোলন দীর্ঘায়িত এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করেছিল। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল বলছেন, গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে গুজব ছড়ানোর দায়ে আহমাদ হোসাইন (১৯) ও নাজমুস সাকিব (২৪) নামে দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে এই সিআইডি কর্মকর্তা জানান, যারা গুজব ছড়াবে তাদের অবস্থান থাকবে দেশের বাইরে। অথচ যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি বাংলাদেশে দেখানো হবে। দীর্ঘ দিন ধরে এমন গুজব ছড়িয়ে সরকার হটানোর পরিবেশ সৃষ্টির পরিকল্পনা আছে তাদের। তারই ধারাবাহিকতায় তারা ছাত্র মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টাও করেছিল। এছাড়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাট আন্দোলন, ২০১৩-১৪ সালের নৈরাজ্য, ২০১৫ সালের টানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, বোমাবাজি ও অগ্নি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালানোর ক্ষেত্রেও গুজবকে কাজে লাগানো হয়েছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই সামাজিক ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করতে না পারলে তা পুরো সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের ওপর রীতিমত ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরো কর্মকান্ড বিকল হয়ে পড়তে পারে। তাই গুজব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কঠোর নজরদারি চলছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের সব বিভাগ কাজ করছে। র‌্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত ওয়াহিদুন্নবী (৪৭), আরাফাত তারুণ্য তামাদি (৩৭) ও আব্দুল্লাহ জাবিদ (৪৫) নামের তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক অপপ্রচার, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে গুজব ছড়িয়ে আসছিল।
×