ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ও ধান ভানিরে...’ সুর আর নেই

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

 ‘ও ধান ভানিরে...’ সুর আর নেই

গল্পটি ব্রিটিশ শাসনামলের। ইংরেজ সাহেবের দরবার। গ্রামের এক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এক ব্যক্তি উচ্চারণ করলেন ‘ঢেঁকি’। ইংরেজ তা বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন মোক্তারকে (দূর অতীতে মোক্তার পদবির ব্যক্তি ছিলেন উকিলের নিচে এক ধরনের উকিল। মোক্তারি পাশ করতে হতো)। তিনি শারীরিক ভঙ্গির সঙ্গে বাংলা মিশ্রিত ইংরেজীতে বললেন ‘স্যার টু ম্যান ঢাপুরঢুপুর ওয়ান ম্যান হ্যাকি দ্যাট ইজ কল ঢেঁকি।’ সেই থেকে ঢেঁকির ললাট লিখন হয়ে আছে এই বাক্যটি। তবে ঢেঁকি যে বাঙালীর গ্রামীণ ঘরগৃহস্থালির অন্যতম বস্তু এই নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। দূর অতীতে ঢেঁকিতেই ধান ভানা হতো। কাঠের চৌকোণা লম্বা একটি শক্ত কাঠমোর পিছনের দিকে ছিদ্র করে তার মধ্যে শক্ত রোলার ও সামনের দিকে মোটা গোলাকৃতির বস্তু এঁটে মাটি থেকে দুই ফুট উঁচুতে রেখে রান্না ঘরের কাছ বসানো হয়। ঢেঁকির সামনের অংশের নিচে নির্দিষ্ট মাপে মাটি খুঁড়ে গর্ত বানাতে হয়। এই গর্তে ধান রেখে ঢেঁকির পিছনের অংশে দুই নারী পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঢেঁকিকে ওপরে তুলে দেয়। ঢেঁকি ওপরে উঠে গর্তে ধানের ওপর পড়ে। এ ভাবে ধান ছেটে চাল বের হয়। এরপর কুলা দিয়ে ঝেরে ধানের খোসা বা তুষ আলাদা করা হয়। এই ঢেঁকিকলে শীত মৌসুমে চালের আটা বানানো হয়। ঢেঁকিকল নিয়ে গ্রামীণ গীত আছে। ‘ও ধান ভানিরে ঢেঁকিত পার দিয়া টাক্কুস ও টুক্কুস...” । ঢেঁকির পিছনের অংশে পা দিয়ে ধাক্কা দেয়াকে বলা হয় পাড় দেয়া। পাড় দেয়াও এক ধরনের কৌশল। একটি ছন্দ। দুই নারীর একটি করে পা একই শক্তিতে ঠিক মতো না পড়লে ঢেঁকি ওপরে ওঠে না। পাড় দেয়ার সময় দুই নারী ওপরে কোন কিছু ধরে নিজের ব্যালান্স ঠিক রাখে। ঢেঁকি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত উঠে সামনের গর্তে পড়ে। এ সময় মিষ্টি শব্দ আসে। একটা সময় গ্রামের প্রতিটি গৃহস্থ ও কৃষক ঘরে ঢেঁকিকল ছিল বাধ্যতামূলক। নিকট অতীতে ঢেঁকির স্থান দখল করে নেয় ধান ভাঙ্গার যান্ত্রিক মেশিন। ইংরেজীতে বলা হয় হাস্কিং মিল। স্থাপিত হয় প্রতিটি বাজারে। এই হাস্কিং মিলের বহুমুখী ব্যবহার শুরু হয়েছে। ধান ভাঙ্গার পাশাপাশি গম যব ভুট্টা মরিচ ভেঙ্গে গুঁড়া করা হয়। প্রযুক্তির অগ্রসরতায় শ্যালো ইঞ্জিনের বহুমুখী ব্যবহারে হাস্কিং মেশিন তৈরি হয়েছে। এই মেশিন গাড়িতে তুলে চলে যাচ্ছে গ্রামের কৃষক ও গৃহস্থ বাড়ির উঠানে। কিষান বধূ এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানে না। ঢেঁকি এখন অতীত দিনের সুখ স্মৃতি। গ্রামের প্রবীণ মানুষ বলে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাতের স্বাদই আলাদা। সেই স্বাদ যন্ত্রের ছাঁটা চালের পাওয়া যায় না। শীতের সময়ে এখন আর আটাও ছাঁটা হয় না ঢেঁকিতে। সবই এখন যন্ত্রে। এতে সময় কম লাগে। যখন ইচ্ছে তখন ভেঙ্গে নেয়া যায়। বর্তমান প্রজন্ম ঢেঁকি দেখেছে। ঢেঁকিতে কিভাবে ধান ভানা হতো তা দেখেনি। শুধু গল্প শুনেছে। এদিকে উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, বহু আগে ঢেঁকির মডেল দেখেই নির্মিত হয়েছে শিশুদের এক ধরনের খেলনা। যা প্রতিটি পার্কের শিশু বিনোদনের স্থানে এবং কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখা আছে। যেখানে শিশুরা দুই প্রান্তে বসে দুলকির মতো খেলে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×