ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উড়াল

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

উড়াল

বিকেলে ছাদে পানি দেয়া সোহাগের একটা বড় কাজ। পঞ্চাশ ষাটটা টব, তাতে পানি দিতে হয়। একদিন বাদ পড়লে খালাম্মা বকাবকি করেন। খালাম্মার হাঁটুতে ব্যথা। ডাক্তার বলেছে, বাত। একটু হাঁটলেই ব্যথায় কঁকাতে থাকেন। তবুও কঁকিয়ে কঁকিয়ে ছাদে উনি উঠবেনই। উঠবেন, গাছগুলো দেখবেন, তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বলবেন, : ভালো হয়েছে। কাল কিন্তু একই সময়ে পানি দিবি। মানুষের যেমন একই সময়ে খাবার লাগে, একটু হেরফের হলে কষ্ট হয়, গাছেদেরও তাই। ওদেরও জীবন আছে। আর হ্যাঁ পানি দেয়ার সময় পানি ঢেলে ছোদ নোংরা করবি না। সাবধানে ঢালবি। মনে থাকবে তো? : থাকবে খালাম্মা। কিন্তু সত্যিই কী গাছের জীবন আছে, কই ওরা তো নড়ে না, কথা কয় না! : আছেরে আছে, দেখিস না কেমন আস্তে আস্তে চারা থেকে বড় হয়, তারপর ডালপালা হয়, ফুল হয় ফল হয়, আবার একদিন মরেও যায়। জীবন না থাকলে এসব হয়? ওদের যে জীবন আছে এটা আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু : সে কে খালাম্মা : সে না, তিনি বল। সম্মান করে কথা বল। উনি বড় বিজ্ঞানী। এই বাংলাদেশের বিক্রমপুরে ওনার বাড়ি। নে তাড়াতাড়ি পানি দেয়া শেষ করে কাপড়গুলো তুলে নিয়ে নিচে আয়। সন্ধ্যে হয়ে এলো। খালাম্মা নিচে নামেন। সোহাগ জানে ওনার নামতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। কেন যে রোজ রোজ কষ্ট করে ওঠেন। ওর ওপর একটু বিশ্বাস করলেই তো পারেন! বিশ্বাস যে করেন না তাও না। মানুষের কাছে বলেন, সোহাগ বড় ভাল ছেলে। মুখ বুজে কাজ করে। মুখ বুজে কাজ করে বলেই কী ও ভাল ছেলে? খালাম্মা কী ওকে ভালবাসেন? বাসেন বোধহয়। একদিন খালুজানকে বলে ছাদে একটা কল আর লম্বা পাইপ লাগিয়ে দিলেন ওর যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য। ভাল না বাসলে কী এটা করতেন! পানি দেয়া শেষ করে সোহাগ জামা কাপড় তোলে। আগে সোহাগ শাড়ি ভাঁজ করতে পারত না। এখন পারে। খালাম্মা শিখিয়েছেন। খালাম্মা বেশ ভালো, ধৈর্য ধরে শেখান। একটুও বিরক্ত হন না। এবার ওকে নিচে নামতে হবে। নিচে অনেক কাজ। চা বানিয়ে সবাইকে চা দিতে হবে। তারপর রাতের ভাত বসাতে হবে। তরকারি অবশ্য খালাম্মা দুপুরে রান্না করে রেখেছেন। কিন্তু ওর নামতে ইচ্ছে করে না। ছাদে রেলিং-এ ভর দিয়ে বসে। বসে আকাশে চোখ ফেলে। সারাটা আকাশজুড়ে পাখি আর পাখি। ঘরে ফিরছে পাখিরা। সারাদিন উড়ে ওরা এখন ক্লান্ত, বাড়ি যাচ্ছে, বিশ্রাম নেবে মার বুকে শুয়ে। সোহাগ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর ওর বাড়ির কথা মনে পড়ে। ও কবে বাড়ি যাবে! কবে মার বুকের মধ্যে ঘুমাবে! ছয়মাস সোহাগ এ বাড়িতে কাজে এসেছে। মাসে বেতন দু’হাজার। সে বেতন ও হাতে নেয় না। খালুজান বিকাশ করে মাকে পাঠায়। সোহাগ ভাল খায়, ভাল পরে। এরা বকাঝকাও করে না। রাতে ড্রইংরুমে পাটি পেতে ঘুমায়। ওর কোন কোনদিন ইচ্ছে করে সারাদিন কাজের পর একটু টিভি দেখতে। পারে না। চোখ ভেঙে ঘুম আসে। সকালে উঠতে হয়, খালুজানের অফিস, রাজু ভাইয়ার স্কুল। খালাম্মার শরীর ভাল না। ওর কত কাজ। এত কাজে ও বাড়ির কথা ভুলে যায়। ছোটবোনটার কথা ভুলে যায়। রাতে বিছানায় শুয়ে ওদের কথা ভাবতে চায়, ওদের মুখটা মনে করে। মনে করার আগেই ঘুমে তলিয়ে যায়। একদিন খালাম্মা আর খালু বেশ গম্ভীর হয়ে আলোচনা করছিলেন, : সোহাগকে বোধহয় আর রাখা ঠিক হবে না ঘর মুছতে মুছতে কেঁপে উঠেছিল সোহাগ। কেন, ওকি কোন দোষ করেছে? ওকে না রাখলে ও যাবে কোথায়? খাবে কী? এরা মাসে দু’হাজার টাকা দেয়। কোথায় পাবে সে টাকা! সোহাগের দুনিয়াটা বড় ছোট। এই তিনখানা ঘরের মাঝে। ও জানে না, এখন কাজ পাওয়া না, কাজের জন্য লোক পাওয়াই দুঃসাধ্য। ও কান খাড়া করে শোনে, : কেন বলত কী হয়েছে? খালাম্মার উদ্বিগ্ন প্রশ্ন : শিশুশ্রম নিয়ে কত কথা হচ্ছে চারদিকে, দেখছ না। শিশুদের দিয়ে ভারি কাজ করানো যাবে না। ওদের এখন পড়ার বয়স, ওরা পড়বে। সরকার যদি বাড়ি বাড়ি সার্চ করতে থাকে তখন : তা যাদের পড়ানোর সামর্থ্য নেই, খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই তারা কি করবে? আর ওকে দিয়ে তো আমরা কোন ভারি কাজ করাই না : কাপড় কাচা, ঘর মোছা, বাটনা বাটা এসব ভারি কাজ না? একজন ঠিকে লোক রাখলেও তো পার। আমার এক কলিগের বাড়িতে কাজের ছেলেটার সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। সে পুলিশে কমপ্লেন করেছে। পুলিশ এসে ওকে বউসমেত এরেস্ট করে নিয়ে গেছে। : সেকী! : তা আমি কি এমনি বলছি। একটু মানবিক হও : ঠিক আছে ঠিক আছে, দেখি একটা ঠিকে লোক পাই কীনা। আর কেউ এলে বলব, ও আমাদের আত্মীয়। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সোহাগ। যাক কাজটা তার যাবে না। তবে সে ঠিকে লোক রাখা হয়নি। সেটা নিয়ে সোহাগের কোন আফসোসও নেই। ও একইভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সব ঠিক ছিল। কিন্তু বিকেলে ছাদে উঠলেই মার জন্য ওর বুকটা হুহু করে। আজ যেন হহুটা বাড়ছে। ও কাঁদতে থাকে। ২ স্কাউট ক্যাম্পে যাবে রাজু ভাইয়া। খালাম্মার খুবই মন খারাপ। : এতগুলো দিন কেমন করে তোকে ছেড়ে থাকব বলত বাপ? আমার ভীষণ খারাপ লাগছে : আমারও। খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে রাজু ভাইয়া সোহাগ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। খালাম্মা দিন রাত চোখে মোছেন। পরদিন কুণ্ঠিত পায়ে খালাম্মার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সোহাগ : খালাম্মা সাতদিনের ছুটি দেন। বাড়ি যাব তিড়িক করে লাফিযে ওঠেন খালাম্মা : বলছিস কী পাগল নাকি! কথা আছে এক বছরের আগে বাড়ি যেতে পারবি না। মাত্র তো ছয় মাস হয়েছে : মা জন্য মন কেমন করছে : তোরা অত মা মা করিস কেন, যা কাজ কর, গাছে পানি দে। সোহাগ আস্তে আস্তে ছাদে ওঠে। গাছে পানি দেয় না, কাপড় গোছায় না। রেলিং-এ বসে। পাখিরা বাড়ি ফিরছে। সোহাগ কবে ফিরবে, কবে। ও রেলিং-এ উঠে দাঁড়ায়। দুপাখা মেলে এবার ও উড়বে। এক পা তোলে তারপর দু’হাত মেলে দেয়। ও উড়ে ছাদে নামে। মনে মনে বলে, মা আমি এসেছি। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×