ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

খামোশ!

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

 খামোশ!

সামনে নির্বাচন। দিনের হিসেবে এক সপ্তাহের চেয়ে একটু বেশি সময় বাকি। মনোনয়ন জমা দেয়া, যাচাই-বাছাই, মনোনয়ন বাতিল, মামলা মোকদ্দমা করে মনোনয়ন ফিরে পাওয়া আর না পাওয়ার প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ। দু-একটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে আছে। আমরা মোটামুটি জেনে গেছি কার সঙ্গে লড়বে কে আর বোঝার চেষ্টা করছি কে আছে কার সঙ্গে, না থাকলে কেনই বা নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমরা এখন মোটামুটি সবাই জানি আমাদের যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী কারা। অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আর বাকিরা নিতে শুরু করেছি। আমরা কে কাকে ভোট দেব আর কাকে দেব না। আমি ঢাকা-১৭ আসনের ভোটার। ঢাকার গুলশান, বনানী, মহাখালী আর ক্যান্টনমেন্ট থানাগুলো নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের এই আসনটি। মনোনয়নের তালিকা দেখার পর আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। আমি দেশের অন্যতম অভিজাত এলাকার ভোটার, আমার সন্তুষ্টির কারণ অবশ্য সেটি নয়। আমার সন্তুষ্টির একটি কারণ আমার এলাকায় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আর এমনকি তৃণমূল বিএনপি ও বাসদেরও প্রার্থী আছেন। আমার সামনে আমার নির্বাচনী এলাকাকে সামনের জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যোগ্যতম প্রার্থী বেছে নেয়ার তালিকাটা অনেক বড়। আমি যে শুধু আমার পছন্দের প্রার্থীকেই বেছে নিতে পারব তাই নয়, অযোগ্য প্রার্থী আর তার দলকে প্রত্যাখ্যানের সুযোগও এই নির্বাচন আমাকে এনে দিয়েছে। তবে আমি নিজেকে সত্যিকার অর্থে সৌভাগ্যবান মনে করছি এই কারণেই যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অন্তত আমার নির্বাচনী এলাকার ব্যালটটিকে কোন জামায়াতীর নাম ছাপিয়ে কলঙ্কিত করেনি। আমার প্রগাঢ় স্বস্তি এই কারণে যে, আমার ব্যালটে আমাকে কোন রাজাকারের নাম দেখতে হবে না। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে, এবারের নির্বাচনের সব নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা আমার মতো অতটা সৌভাগ্যবান নন। এবারের নির্বাচনে ২২টি আসনের ভোটাররা তাদের ব্যালটে কোন না কোন চিহ্নিত জামায়াতীর নামের পাশে ধানের শীষ প্রতীকটি দেখতে পাবেন। অথচ এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। নৈতিকতা কিংবা প্রজাতন্ত্রের আইন, কোন বিচারেই নয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গঠন প্রক্রিয়ার শুরুর দিকে ফ্রন্টের নেতারা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন তারা জামায়াতের সঙ্গে কোন ধরনের ঐক্যে যাবেন না। তাহলে নির্বাচনের এই পর্যায় এসে কেন ওদের নামের পাশে ধানের শীষ প্রতীক? উদীয়মান সূর্য, গামছা, দাঁড়িপাল্লা সব কেন আজ ধানের শীষে একাকার হয়ে গেল। প্রশ্ন করলে হয়ত গর্জে উঠবেন, ‘খামোশ’! বলতেই পারেন। পাকিস্তানের সিন্ধের সামন্তপ্রভুর জামাতা বলে কথা। একাত্তরের ন’টি মাস করাচীতে এসি কামরায় থেকেছেন, খেয়েছেন, শোনা যায় ওকালতিও করেছেন। অতএব মনমানসিকতা যে সামন্ত প্রভুদের মতোই হবে তাতে আর অবাক হওয়ার কি? তিনি পেশাদার উকিল। সব কিছুকেই হয়ত পেশাদারিত্বের সঙ্গেই নেন, পেশা হিসেবেই গ্রহণ করেন। কাজেই নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তিনি আগামী নির্বাচনে তার জামায়াতী মক্কেলের এজেন্ডা নিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে নামতেই পারেন। এমনটি ধারণা করছি কারণ ওই যে কথায় আছে না, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই নি!’ তা-ই যদি না হবে কেন তিনি হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে গেলেন, কত টাকার বিনিময়ে তার দিকে ওমন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের ব্যালটকে ওরা কলঙ্কিত করেছে আরও নানাভাবেও। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তদন্তাধীন কিংবা বিচারাধীন একাধিক যুদ্ধাপরাধীর নামের পাশে ওরা সেটে দিয়েছে ধানের শীষ। এদের মধ্যে একজন আবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের হুলিয়া মাথায় নিয়ে ফেরারিও। ব্যালটে আরও আছে এমনি আরও অনেকের নাম যারা দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তারা কখনই তাদের দন্ডিত আত্মীয়দের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা তো দূরে থাক, অনুতপ্তও হয়নি। বরং তাদের আত্মীয়দের দন্ডকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে প্রকাশ্যে, চরম ঔদ্ধত্যে। বার বার ব্যক্ত করেছে ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধের স্পৃহা। নীতিহীন লোকের কাছে নৈতিকতা প্রত্যাশিত নয়। আমি তাই প্রত্যাশাও করি না যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কাছে আমি কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত পাব। আমি বরং অবাক হয়েছি আইনের প্রায়োগিক অনুপস্থিতিতে। আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কারণেই নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নিবন্ধন বাতিল করেছেন। যে কারণে জামায়াত হারিয়েছে তার দাঁড়িপাল্লা প্রতীক, হারিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকারও। একটি দল কিন্তু একটি অবক্ষ বিষয়, একটি আদর্শ, একটি ধারণা মাত্র। দলের শরীরী অবয়ব হচ্ছে তার সদস্যরা। কাজেই দল যখন রাজনৈতিক অবয়ব হারায়, হারায় নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার, ওই একই কারণে ওই দলের যে কোন সদস্যেরও নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার রহিত হয়ে যায়। নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোন সুযোগই তাদের আর থাকতে পারে না। এটিই আইনের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা, সিম্পল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। তারপরও এ বিষয় নিয়ে কলম ধরার আগে আমি আমার একাধিক আইনজ্ঞ সহকর্মীর সঙ্গে এ বিষয় পরামর্শ করেছি। আমি জেনে অবাক হইনি যে, আগামী নির্বাচনে জামাতীদের অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননারই শামিল। আমাদের নির্বাচন কমিশনকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন্ পথে হাঁটবেন- আইন আর নৈতিকতার পথে, না এর উল্টো দিকে। পাশাপাশি আমাদের পবিত্রতম ব্যালটকে যারা কলঙ্কিত করার দুঃসাহস দেখিয়েছে তাদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়ার দিনও আমাদের সামনে সমাগত। আমাদের সংবিধান রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে সবাইকে, দেয়নি শুধু পাগল আর রাষ্ট্রদ্রোহীকে। কিন্তু আমাদের ব্যালটকে কলঙ্কিত করার অধিকার নেই কারোরই। এ অধিকার এ জাতি দেয়নি কাউকেই। আগামী ত্রিশ তারিখ আমাদের জন্য এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে এই অসুস্থ রাজনীতি আর এই অসুস্থ রাজনীতির যারা চর্চা করে তাদের চিরতরে প্রত্যাখ্যান করার। আসুন, সত্তরের নির্বাচনের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমরা সত্তর শতাংশ বাঙালী আগামী ত্রিশে ডিসেম্বর ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়ে, আঙ্গুল উঁচিয়ে ওদের বলে দেই ‘খামোশ’!! লেখক : চিকিৎসক ও গবেষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×