ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

আরেক বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

আরেক বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে /ইয়াহিয়া তোমায় আসামির মতো জবাব দিতেই হবে’- একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যখন বেজে উঠত মোকসেদ আলী সাঁইয়ের স্বরচিত সুরারোপিত তারই কণ্ঠে গানটি আমরা তখন রণাঙ্গনে শত্রু হননে শশব্যস্ত। দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে একে একে মুক্ত হচ্ছে তখন বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতি ইঞ্চি মাটি। ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীদের বাঙালী জবাব দিয়েছিল তাদের পরাস্ত এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। সারা বাংলা ছিল জেলখানা তাদের সশস্ত্র পাহারায়। কিন্তু তা নয় মাসের বেশি টেকেনি। বিজয়ের ৪৭ বছর পর আরেক যুদ্ধ জয়ের পথে আজ বাংলাদেশ। বাংলার ঘরে ঘরে আজ তাই উড়ছে মুক্তির নিশান, যে মুক্তির কথা বঙ্গবন্ধু সাত মার্চের ভাষণে বলেছিলেন। সে মুক্তি অর্থনৈতিক মুক্তি। গত দশ বছরে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাত ধরে অর্থনৈতিক মুক্তির রথে চড়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে। আর আগামীতে তিনি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ উন্নয়ন দর্শন। শহরের সুবিধা গ্রামেই পাওয়ার পথ ও পন্থা তিনিই তৈরি করে দিতে চাইছেন। কিন্তু এই চাওয়ার পরিধি সম্প্রসারণ তখনই সম্ভব যখন আবারও তিনি ক্ষমতায় আসীন হতে পারবেন। আর এই পথ তৈরি করে দিতে পারে জনগণ, যে জনগণ তার শাসনামলে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। উন্নয়নের যে সোপান শেখ হাসিনা তৈরি করেছেন সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় দেশবাসী তাদের নিজেদের স্বার্থে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা এখন চারদিকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ক্ষমতায় আসার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি হবে বিকশিত। হ্রাস পাবে আয় বৈষম্য। কর্মসংস্থান বাড়বে কৃষিতে। আর অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে কৃষক পাবেন উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ আগামী পাঁচ বছরে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া লক্ষ্য। আর এই যাত্রায় দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরাও হবো পথযাত্রী। কারণ, শেখ হাসিনার পথই হচ্ছে এগিয়ে চলার। সামনে যাই থাক, আসুক যত প্রতিবন্ধকতা সব কিছু ভেঙ্গেচুরে, দুমড়ে-মুুচড়ে মসৃণ পথরেখা তৈরি করে নিতে পারেন শুধুই তিনি। শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র আজ এক এবং অভিন্ন। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির দিগন্তে। উদার আকাশ আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনাই পারেন দেশবাসীকে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আহবান জানাতে। জানিয়েছেনও তিনি। তাই তার পথ ধরে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দর্শন হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলো আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় হয়ে উঠছে সমৃদ্ধ অঞ্চল। মঙ্গা, অভাব, দুর্ভিক্ষ, দুঃখ, দারিদ্র্য ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে দেশের মানুষ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আবার ক্ষমতায় বসাবে বলে বিশ্বাস। এই নির্বাচনে একজন প্রার্থী হিসেবে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে শেখ হাসিনার চিন্তা-চেতনা এবং দেশের উন্নয়নে তার অবদান যখন তুলে ধরি, মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করছে তারা এখন দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে-পরে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে সুখে-শান্তিতে যেমন রয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করতে পারছে। বেকারত্বের অভিশাপে কেউ আর জর্জরিত নয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো যখন জ্বলে, তখন তারা সেই আলোতে প্রজ্বলিত করে শেখ হাসিনার মুখ। জনগণ চায় না স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকরা আবার ক্ষমতায় আসুক। চায় না দেশ যাক রসাতলে। মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা আর পাকিস্তানী মানসিকতাকে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করে দিতে মানুষ এবার শেখ হাসিনা ও তার মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় শামিল হতে চায়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে যারা হত্যা করতে চেয়েছিল, সেই বিএনপি-জামায়াতকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না বাংলার মানুষ। দেশবাসী বিস্মিত, যখন জামায়াতকে বক্ষে নিয়ে বিএনপি এবং ড. কামাল হোসেনরা মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আসলে বিএনপি এত সাহস পেত না যদি না ‘সো-কলড’ ঐক্যফ্রন্ট তাদের সঙ্গে যোগ দিত। যারা আছেন সমাজে তাদের প্রো-লিবারেশন ফেস রয়েছে। যেমন ড. কামাল হোসেন, মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুলতান মনসুর, আ স ম আবদুর রব। সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক আবু সাঈয়িদ এবং বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বোমা হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার পুত্র রেজা কিবরিয়া। তার একটা অভিমান থাকতে পারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে, তার বাবা কিবরিয়ার হত্যার বিচার এখনও হয়নি কেন? এ প্রসঙ্গে আমি তার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, বলা উচিত প্রশ্ন করতে চাই, বঙ্গবন্ধু ও ৪ নেতার হত্যার বিচার হলো কত বছর পর? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যার বিচারও হলো কত বছর পর? তারপরও বলব ঐক্যফ্রন্টের নামে যে মানুষগুলো তারেক, খালেদা এবং দÐ কার্যকর করা নিজামী, গোলাম আযম গোষ্ঠীর প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালেন তাদের লজ্জা না থাকতে পারে, আমাদের লজ্জা আছে। কেননা তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী নন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে তাদের একটা ফেস ভ্যালু আছে (যদিও ভোটে নেই, হয়ত সে কারণেই ড. কামাল ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন)। এই দুর্ভাগা দেশ, দেশের জাতির পিতাকে হত্যা করতে যাদের বুক কাঁপে না, হাত বেঁকে যায় না, তারা জঙ্গী-জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে হাত মেলাবেন তাতে অবাক হই না। আদালতের ভাষায় সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত এবং তাদের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন শিবির যেটি বিশ্বের ২ নং সন্ত্রাসী সংগঠন, তারা কিভাবে এখনও বাংলাদেশে রাজনীতি করছে, তাতে অবাক না হয়ে পারি না। এখন নির্বাচন কমিশনেরও অগ্নিপরীক্ষা। কমিশন এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি নিবন্ধন বাতিল করেছে, এখন নির্বাচনে তাদের প্রার্থিতার বৈধতা দেবেন কি করে? স্বাভাবিকভাবেই তাদের নমিনেশন বাতিল হওয়ার কথা। বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলছেন ‘জঙ্গী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে।’ অনেকে অবাক হয়েছেন। আমি বলি উনি ঠিকই বলেছেন, মিলিটারি জিয়া, নজরুল ইসলাম খান, ব্যারিস্টার মওদুদ, এরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের মানুষ। তারা তো জঙ্গী-জামায়াত নিয়েই ঘর করছেন। সেইসঙ্গে রয়েছেন আ স ম আবদুর রব, মোস্তফা মহসিন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাঈয়িদ, সুলতান মনসুর- এই মুক্তিযোদ্ধারা যোগ দেয়ার পর অনায়াসেই বলা যায় জামায়াতে মুক্তিযোদ্ধা আছে। পঞ্চাশ বছরে কি দেখছি? ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জীবনের দিনগুলো যদি জীবনে না থাকত তাহলে কোন কষ্ট পেতাম না। ক্ষমতা মানুষকে এত অন্ধ করতে পারে অগ্রজদের কাছে অনেক শুনেছি, বিশ্বাস করিনি। আজ তা জীবনের বাস্তবতা। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আবদুর রব (যাকে লিডার অথবা রব ভাই বলে ডাকি), মন্টু ভাই, যারা ক্যাম্পাসে আইয়ুবের চামচা মোনেম খান হিংস্র এসএসএফ-অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন, তারা আজ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন! তারা কি বিএনপি-জঙ্গী-জামায়াতের হিন্দু তাড়াও আন্দোলনে শরিক হবেন? এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। কিন্তু নির্বাচন এলেই গর্তের বিষাক্ত কীটরা বেরিয়ে আসে। যে চিত্র আমরা দেখেছি ভোলায়, নাসিরনগরে। বিশেষ করে ২০০১-এর নির্বাচনের পর দেশব্যাপী জঙ্গী-জামায়াত ও বিএনপির অত্যাচার-নির্যাতন-হত্যা, চোখ উপড়ানো, হাত-পা’র রগকাটা, কব্জি কাটা, সংখ্যালঘু ও নৌকার কর্মীদের বাড়ি, গাছ, গরু এবং পুকুরের মাছ লুটের ঘটনা, খুব বেশি দিনের কথা নয়। গ্রামে-গঞ্জে ওদের চাঁদা না দিয়ে কোন হিন্দু বা নৌকার সমর্থক দোকানদার দোকান খুলতে পারেনি। তখনও আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেক্যুলার শক্তি রুখে দাঁড়িয়েছে। তারপর বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সেক্যুলার ফোর্স ক্ষমতায় এলে চিত্র পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার কঠোরহস্তে জঙ্গী-সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির রেখে যাওয়া সমাজ পাল্টে দেয়। সেই থেকে দেশকে যেমন গণতান্ত্রিক পথে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে এমন উচ্চতায় তুলে আনেন যে, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে এক লোভনীয় ‘ব্র্যান্ড’। এই কদিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিজয় হয়েছে। এই বিজয় কেবল সাংবাদিক সমাজের নয়, বাংলার মানুষেরও। এই বিজয় ত্রিশে ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। আর সাতদিন পর নির্বাচন। সারাদেশ নির্বাচনী উৎসবে মাতোয়ারা। শীতের আমেজে নির্বাচনী উত্তাপ এসে ভোরের রোদকে সতেজ করে তুলছে। এবারের ভোটের সেøাগান ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রার্থীকে ভোট দেব।’ নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল তারকা শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরীর কন্যা ডাঃ নুজহাত চৌধুরী বিশ্বাস করেন, যে নতুন প্রজন্ম এবার ভোটার হয়েছেন তারা প্রথম ভোটটি দেবেন মুক্তিযুদ্ধের প্রার্থীকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রার্থীকে। তরুণ বন্ধুদের প্রতি আগাম অভিনন্দন যে, এই যুদ্ধে তারাও জয়ী হতে যাচ্ছেন। ঢাকা ॥ ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×