ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

নারীরা যাদের ভোট দেবেন

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

নারীরা যাদের ভোট দেবেন

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রাজনৈতিক সঙ্কট থাকলেও রাজনীতিতে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূভাবে উপস্থাপন ও কার্যকরণের ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের সুদূরপ্রসারী ভাবনা ও চিন্তাধারার মিথষ্ক্রিয়া ব্যতীত রাজনৈতিক সঙ্কট দূর করা সম্ভব হবে না। কেননা, নতুন প্রজন্মের সারথীরা আগামী বাংলাদেশের কর্ণধার, তাদের হাতেই স্বপ্নের সোনার গড়ার দায়িত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে সমগ্র বাংলাদেশে নির্বাচনের সুবাতাস বয়ে চলেছে। প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য ও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে; প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিস্তার ও প্রসারতার ক্ষেত্রে এটি যৌক্তিকতার মিশেলে অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক। এখন সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচনকে কমিশনকে যে কোন মূল্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসাধারণের মতামতের/রায়ের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অন্যথায়, বাধাগ্রস্ত হবে ইতিবাচক রাজনীতির সংস্কৃতির বাতায়ন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্য রাজনৈতিক দল, জনগণ, পর্যবেক্ষক টিম ও সাংবাদিক সমাজের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণের চাহিদা ও আশানুরূপ ইশতেহার প্রদান করে থাকে। ইশতেহার প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে ইশতেহার প্রদানের চেষ্টা করে থাকে। এক কথায় নতুন ভোটারদের চাওয়া পাওয়াকে বিবেচনায় নিয়ে ভোটারদের আকর্ষণের নিমিত্তে ইশতেহার প্রদান করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। আমরা যদি কিছুটা পেছনের দিকে ফ্ল্যাশব্যাক করি, তাহলে দেখতে পাই, ১৯৯১ সালে জয়ী দল মোট ভোটারের ৩০.৮ শতাংশ এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল ৩০.১ শতাংশ ভোট পায়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত দল ৩৭.৪ শতাংশ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দল ৩৩.৬ শতাংশ ভোট পায়। ২০০১ সালে নির্বাচিত দল ৪১.৪ শতাংশ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দল ৪০.২ শতাংশ ভোট পায়। এই তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জয়ী দল এবং পরাজিত দলের মধ্যে ভোটের সামান্য ব্যবধানই দেখা যায়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটার তাদের পছন্দের দলকে ভোট প্রদান করে থাকে, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতির কারণে কিছু শতাংশ ভোটের রকমফেরের কারণে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু চমকটা দেখা যায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে, এ নির্বাচনে জয়ী দল ৪৯.১৩ শতাংশ এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল ৩৩.১৫ শতাংশ ভোট পায়। অর্থাৎ ভোটের ব্যবধান দেখা যায় অধিক পরিমাণে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত ফ্লোটিং (ভাসমান) ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে যারা নানাবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে দল মনোনয়নকৃত প্রার্থীদের ভোটাধিকার প্রণয়ন করে থাকে। এ নির্বাচনেও তরুণ প্রজন্মের ভোটাধিকার নির্বাচনে জয়লাভের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। কারণ, তারা নির্দিষ্ট কোন দলের কট্টর সমর্থক নয়। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রার্থীদের সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করেই ভোটাধিকার প্রদান করবে। তাই, তাদের ভোট নিজেদের দলের প্রার্থীর পক্ষে আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ভেবেচিন্তে ইশতেহার প্রদান করে থাকে। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায়, দেশের প্রায় ২২ শতাংশ ভোটারের বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। এসব তরুণের বড় অংশ প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ এবারই প্রথম ভোট দেবেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন এবং ২০০৮ সালে ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩ জন। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ৩১ লাখ ৩ হাজার ৪৭৭ জন (সূত্র : প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮)। কাজেই এ তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা প্রার্থীর জয়লাভের ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করবে। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার ইস্যু, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা, ভূ-রাজনৈতিক চরিত্র, আন্তর্জাতিক অংশীজনদের সঙ্গে যোগাযোগের সম্পর্কোন্নয়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য বিষয়কে সামনে রেখে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা ভোটাধিকার প্রদান করে। আসন্ন নির্বাচনে নতুন ভোটার হওয়া নারীরা কেমন প্রার্থীকে ভোট দেবেন তা জানতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং শিক্ষয়িত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আলোচনায় বিভিন্ন প্রেক্ষিত এবং রাজনীতি নিয়ে অনেক বিরূপ অভিব্যক্তিও ফুটে উঠেছে। তবে সবার কথাই একটি বিষয় উঠে এসেছে, প্রার্থীকে অবশ্যই সৎ এবং দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষয়িত্রী বলেছেন : প্রার্থীকে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের সচিত্র উপস্থাপন করতে হবে; আর যারা আশ্বাস দিয়েছেন কাজের কাজ কিছুই করেননি তাদের ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। সুস্থ রাজনীতির চর্চায় বিশ্বাসী, সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার উদাহরণ স্থাপন করে সমাজের বসবাসরত মানুষের জন্য ত্যাগের নমুনায়ন সৃষ্টি করেছেন এমন প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। তিনি জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন : প্রার্থীকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের হতে হবে, এমনকি প্রার্থীর পূর্ব পুরুষ যদি দেশবিরোধী (যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত) কোন কাজে জড়িত থাকে তাহলে তাকেও বয়কট করা হবে নির্বাচনে। ভোট কেনা বেচার যে সংস্কৃতির মিথ লোকমুখে শোনা যায় যে কোন মূল্যে আসন্ন নির্বাচনে তা বয়কট করতে হবে এবং যে সব প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা ভোট কেনার সঙ্গে জড়িত তাদের অবশ্যই ভোট দেবে না নতুন প্রজন্ম। কারণ বাংলাদেশে উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা চলমান রয়েছে তা কোনভাবেই স্থবির হতে দেয়া চলবে না। কেননা, আর যাই হোক না কেন; ভোট কিনে জয়ী হওয়া প্রার্থীরা দেশ তথা জনগণের কোন কল্যাণে আসবে না। একজন শিক্ষার্থী যিনি নব্য ভোটার হয়েছেন : তিনি বলেছেন-প্রার্থীকে অবশ্যই রাজনীতিবিদ হতে হবে, রাজনীতিবিদ না হলে প্রার্থী পাস করার পরে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্তায়ন না হলে দেশ ও দশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন কখনই সম্ভব হবে না। রাজনীতিবিদ না হলে সাধারণ জনগণ তাদের সমস্যা ও নানাবিধ যৌক্তিক ইস্যু নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। দেখা করতে পারলেও জনগণের মতামতকে সেভাবে তোয়াক্কা করেন না। কাজেই, প্রার্থীকে অবশ্যই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে, অন্যথায় তারা ভিন্ন পেশার প্রার্থীকে নির্বাচনে ভোট দেবেন না। অন্য একজন শিক্ষার্থী বলেছেন : প্রার্থীকে অবশ্যই উচ্চ শিক্ষিত এবং সৎ হতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে এবং সেখানে প্রার্থীর ন্যূনতম শিক্ষার বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী থাকার বিষয়ে বাধ্যতামূলক করতে হবে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে উল্লেখ করেন; টাকা থাকলে যে কেউ জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছে পোষণ করে থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের মনোনয়ন দিয়ে থাকে। এ ব্যবস্থার পরিত্রাণ হওয়া প্রয়োজন, মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা আমরা শুনে থাকি। প্রার্থী যদি টাকাওয়ালা হন, তাহলে তিনি টাকা খরচ করে দলের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ ব্যবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে কিছু কিছু প্রার্থীর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে যদিও তাদের দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না তথাপি তাদের নিজের কাছে যে সব প্রার্থীর কার্যকলাপ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে তাদের নতুন প্রজন্ম ভোট প্রদানে বিরত থাকবে। একজন শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেছেন : যে সব প্রার্থী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপী হওয়ার ভয়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে ঋণ আদান/প্রদানের হিসাব নিয়মিত করেছেন তাদের তিনি ভোট দেবেন না। তিনি আক্ষেপ করেছেন এ মর্মে, যেখানে সাধারণ মানুষ ব্যাংক ঋণ পেতে হিমশিম খায় সেখানে রাজনীতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে বড় অংকের টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপী হওয়ার প্রক্রিয়ায় ধাবমান, তারা প্রার্থী হলে তাদের নতুন প্রজন্মের নারীরা ভোট দেবে না। অন্য একজন শিক্ষার্থী বলেছেন : ক্ষমতার দম্ভে যারা পুলিশ, প্রশাসন, সাংবাদিকসহ প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থাগুলোকে হুমকি দিয়ে ভোটের পূর্বেই ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে এবং কিছু কিছু জায়গায় দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে তাদের ভোটের মাঠে নতুন ভোটাররা বয়কট করবে। কারণ, ক্ষমতায় না এসেই যেভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন এবং ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করে ইচ্ছামতো যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন তারা ভোটে জয়লাভ করে আসলে আর যাই হোক দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে পারবে না। কাজেই, এবারের নির্বাচনে নব্য নারী ভোটারদের ভোট পেতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর মনোনয়ন নিশ্চিত করতে হবে। দলের চেয়ে প্রার্থীর মূল্যায়ন করে নারীরা প্রার্থীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে। অসৎ, চরিত্রহীন, আগুন সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ইন্ধনদাতা, ঋণখেলাপী, জনগণের কাছে প্রদেয় ওয়াদার বরখেলাপকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত এহেন চরিত্রের অধিকারী প্রার্থীদের নারীরা তাদের পবিত্র ভোটাধিকার প্রদান করবে না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য; পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অনুপ্রেরণায় প্ররোচিত হয়ে অনেক সময় নারীরা তাদের ভোট প্রদান করতেন। কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফলে নারীরা প্রত্যেক প্রার্থীর হলফনামা ও রাজনৈতিক দলগুলোর আমলনামা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল। সুতরাং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নারীরা তাদের বিচার, বুদ্ধি, বিবেক এবং আবেগের সম্মিলন ঘটিয়ে তাদের দৃষ্টিতে উপযুক্ত প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রদান করবেন। আমরাও আশা রাখি, বাংলাদেশের ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকরা তাদের পবিত্র ভোট প্রদানের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনের মাধমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করবে। তা হলেই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ধাবমান বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
×