ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আশরাফ পিন্টু

বিভূতিভূষণের কিশোর গল্পে বিষয়-বৈচিত্র্য

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

বিভূতিভূষণের কিশোর গল্পে বিষয়-বৈচিত্র্য

কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাচালী’র লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বাংলাসাহিত্যের এক প্রতিভাধর কথাসাহিত্যিক। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শরৎচন্দ্রের পরেই তাঁর অবস্থান। তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল জীবনদৃষ্টি দিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের জীবনচিত্র এঁকেছেন। ফলে তাঁর গল্প উপন্যাসেও সাধারণ মানুষ ও গ্রামবাংলার নিসর্গের ছবি অপূর্ব দক্ষতায় ফুটে উঠেছে। তাঁর কিশোর গল্পগুলোতেও বিষয়-বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। অনেকে মনে করেন শুধু শিশু সাহিত্যিকরাই শিশু-কিশোরদের জন্য ভাল লিখতে পারেন। কিন্তু সবক্ষেত্রে এ কথা সত্য নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভূতিভূষণের লেখায়। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মতোই তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন সুন্দর সুন্দর গল্প। বাল্যকালের স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’। ১৯২৯ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। কিশোর-কিশোরী অপু-দুর্গার দুরন্ত কৈশোরের যে কাহিনীÑ সে কাহিনী বাংলা শিশুসাহিত্যে অমর হয়ে আছে। এরপর তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক গল্প লিখেছেন। এ গল্পগুলো বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তাঁর গল্পে আছে দরিদ্র মানুষের করুণ কাহিনী, কৈশোরের দুরন্ততা, হাস্যরস, রূপকথার কাহিনী, এ্যাডভেঞ্চার ও শিশু-কিশোরদের প্রিয় বিষয় ভৌতিকরসের গল্প। এমনি বিবিধ বিষয়-বৈচিত্র্যে তাঁর গল্পগুলো ভরপুর। এখন আমরা তাঁর কয়েকটি গল্প আলোচনা করে এর স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টা করব। মানুষের শৈশব ও কৈশোর হলো এক চিন্তাহীন দুরন্তকাল। একালে শিশু-কিশোরদের মনে থাকে নানা ফন্দি, নানা দুষ্টবুদ্ধি। বিশেষ করে কৈশোর বয়সে দেখা যায় এর গাছের কাঁঠাল চুরি করা, ওর বাড়ির বড়ই গাছে ঢিল ছোড়া, অন্যের ক্ষেতের কাঁকর-বাঙি তুলে নিয়ে আসা- এ রকম বিভিন্ন দস্যিপনায় তারা ব্যস্ত থাকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন দুটি গল্প হলো ‘বর্শেলের বিড়ম্বনা’ ও ‘হারুন-অল-রশিদের বিপদ’। গল্প দুটিতে দুরন্ত কৈশোরের নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়। ‘বর্শেল’ অর্থাৎ বড়শি দিয়ে মাছ ধরার পাকা শিকারি হলো সন্তুদের গ্রামের রামহরি হোড়। দশাসই চেহারার রামহরিকে ছেলেপুলে ভয় করে চলে। তিনি বিভিন্ন রকম মসলা দিয়ে ও কৌশল করে মাছ ধরে থাকেন। তার মাছ ধরার পদ্ধতি কেউ জানে না। এই রামহরি এক সময় কথা প্রসঙ্গে সন্তুদের কাছে মাছ ধরার পদ্ধতি বলে ফেলে। একটি বড় মাছ তার ছিপ ভেঙে চলে গেলে তিনি বাড়ি ফিরে যান। ভাগ্যক্রমে সেই মাছ সন্তুদের হস্তগত হয়। এক অনাবিল হাস্যরসের মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়েছে। ‘হারুন-অল-রশিদের বিপদ’ গল্পে দেখা যায়- হারুনের শিক্ষক বিপিন মাস্টার খুব কড়া প্রকৃতির লোক। পড়া না হলে তিনি খেজুরের ডালের বেত দিয়ে মারেন। পড়া থেকে রেহাই পাবার জন্য হারুন আর আবুল বিপিন মাস্টারের বাড়িতে দুইটি এঁচোড় (কাঁঠাল) দিয়ে আসে। স্কুলে দেরিতে পৌঁছলে বিপিন মাস্টার ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘দেরি কিসের?’ পিঠে বেত পড়ার আগেই হারুন চালাকি করে তার বাড়িতে কাঁঠাল দিয়ে আসার কথা বলে। ওর কথাতে সাপের মাথায় গাছ দেয়ার মতো অবস্থা হয়- মুহূর্তে মাস্টারের রাগ পানি হয়ে যায়। বিপিন মাস্টারের হাত থেকে হারুন রেহাই পেলেও পরবর্তীতে ভাগ্যের ফেরে এক মহাবিপদে পড়ে যায়। হঠাৎ ওইদিন ইন্সপেক্টর সাহেব এসে হারুনকে রহস্য করে উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন ধরেন। হারুন কিছুই বুঝতে পারে না, চোখ ছাপিয়ে জল পড়তে থাকে। পরে ইন্সপেক্টর সাহেব বুঝিয়ে দেনÑ ‘তোমার নামটা খুব বড় একজন ভাল লোকের নাম। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ লোক, বুঝলে, যাও...।’ গল্পে বিপিন মাস্টারের কঠোরতা, কাঁঠাল পেয়ে সে নীতির পরিবর্তন, হারুনের দুরন্তপনা, ওর নাম প্রসঙ্গে বাগদাদের স্বর্ণযুগের খলিফা হারুন অর রশিদের মহানুভবতার কথাও এসেছে। লেখক নির্মোহ দৃষ্টিতে গল্পটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সই’ এবং ‘গল্প নয়’ গল্প দুটোতে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কাহিনী ফুটে উঠেছে। ‘সই’ গল্পে দেখা যায়- নিম্নবিত্ত এক মহিলা তার শিশুপুত্র হাবুলকে সঙ্গে নিয়ে দুপুর বেলা আসে তার সই অর্থাৎ বাল্যবন্ধুর বাড়িতে। তাদের পেটে যে ক্ষুধার অনল জ্বলছে তা প্রথমে উপলব্ধি করতে পারে না লেখকের বোন অর্থাৎ সই। পানি খেতে চাইলে সই এক গ্লাস পানির সঙ্গে একটু গুড় খেতে দেয়। তখন তাদের অভুক্ত থাকার স্বরূপ প্রকাশ পায়। এরপর লেখকের ভাগ্নে গোলাপছড়ি কেনার সময় হাবুলের হাতে একটি গোলাপছড়ি দেয়। হাবুলের মা ছেলের হাতে থেকে একটু গোলাপছড়ি মুখে দিলে ছেলে বলে, ‘না, মা, হু। আর তোমাকে দেব না। আমি তবে কি খাব?’ এক দারিদ্র্যপীড়িত মা ও শিশুর বুভুক্ষতার রুদ্র মূর্তি ফুটে উঠেছে এ গল্পে। নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্তের মধ্যে যে বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব থাকে না- তা এ গল্পে পরিস্ফুট। ‘গল্প নয়’ গল্পে দেখা যায়-বাৎসল্য রেেসর একটি রসঘন বর্ণনা। এক বুদ্ধ মা-হারা একটি ছোট্ট শিশুকে ট্রেনে নিয়ে যাচ্ছে। শিশুটি অসুস্থ। ট্রেনের কারও ওদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু এক তরুণী অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে শিশুটিকে দেখছে। দরদ ভরা কণ্ঠে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে বৃদ্ধকে। পরিশেষে লেখক মাতৃস্নেহের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এভাবে : ‘এই গাড়ির মধ্যে এত পুরুষ মানুষ ছিল, কেউ ফিরেও চেয়ে দেখেনি ছেলেটার দিকে। সনাতনা মাতৃরূপা নারী দুটি এসে মাতৃহীন মৃত্যু পথযাত্রী শিশুকে মাতৃ স্নেহের বহু পুরাতন অথচ চির নতুন বাণী শুনিয়ে দিলে।’ শিশু-কিশোররা রূপকথা, এ্যাডভেঞ্চার ও ভৌতিক গল্প বেশি পছন্দ করে। এই তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে ‘রাজপুত্র’, ‘বাঘের মন্তর’ ও ‘ভৌতিক পালঙ্ক’ গল্পে। ‘রাজপুত্র’ গল্পটি রূপকথার আদলে লিখিত কিন্তু এর মধ্যে রূপকথার কোন অলৌকিক ঘটনা নেই। যা আছে তা হলো- অতীত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানবিকতা প্রতিষ্ঠা। রাজপুত্র ভ্রমণে বেরিয়ে এক অজানা রাজ্যে চলে আসে। বনে-বাদাড়ে কিছুদিন ঘুরে শেষে এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ির লোকেরা অতি যত্নের সঙ্গে তাকে আদর-আপ্যায়ন করে। একদিন সে হঠাৎ শুনতে পায় রাজার আদেশে গৃধ্যকুট পর্বতের পাদদেশে এক কাপালিক নরবলি দেয় প্রতি অমাবশ্যা রাতে। তার কাছে প্রতি গ্রাম থেকে একজন করে শিশু পাঠানো হয়। যে বাড়িতে রাজপুত্র আশ্রয় নিয়েছে সেই বাড়ির আজ পালা। বাড়ির সবার চোখেই জল। অবশেষে দেখা যায়Ñগৃধ্যকুট পর্বতের পাদদেশে কাপালিক ও রাজপুত্র উভয় মরে পড়ে আছে। রাজপুত্র নিজের জীবন দিয়ে সকলকে বিপদ মুক্ত করে যায়। এ্যাডভেঞ্চারধর্মী গল্প হলো ‘বাঘের মন্তর’। রায় বাহাদুর অনুকূল মিত্র একজন মস্ত শিকারি। তিনি বাঘসহ অনেক পশু শিকার করেছেন। তাঁর বাড়িতে একদিন দেখা গেল নিধিরাম ভট্টাচার্যকে। তিনি বাঘ ধরার মন্তর-তন্তরে বিশ্বাস করেন না; তবে তিনি মন্তর সম্পর্কে একটি ঘটনা জানেন। বাঘ শিকার করতে গিয়ে সুন্দরবনে তিনি এক ফকিরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সে নাকি মন্তর দিয়ে বাঘ আনতে পারে। তিনি বাঘ শিকারের জন্য ফকিরকে নৌকায় উঠিয়ে নেন। ফকির মন্তর দিয়ে বাঘ ডেকে এনেছিল কিনা সেটা রহস্য থেকে যায়; তবে ফকির দলের সামনে থাকায় বাঘটি ফকিরকেই ধরে নিয়ে যায়। এ গল্পে লোমহর্ষক কথার মাঝে মাঝে আছে বাঘ শিকারের অনবদ্য বর্ণনা। ভূত না থাকলেও ভৌতিক কাহিনী আমাদের রোমাঞ্চিত করে। এমন এক আদি ভৌতিক রহস্যময় কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ভৌতিক পালঙ্ক’ গল্পটি। এক চিনা গলি থেকে একটি পুরনো চৈনিক খাট কিনে নিয়ে আসে সতীশ। এই খাটে শুয়েই যত অলৌকিক ঘটনা ঘটে। সতীশ ভয় পেয়ে পরেরদিন গল্পকথক বন্ধু খগেনকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় বাড়িতে। রাত্রি পালাক্রমে তারা ওই খাটে শোয়। পরিশেষে দুজনকেই দেখা যায়Ñ সদর দরজার মাটিতে গোঁ গোঁ করতে। এই গল্পে ভৌতিক রহস্যের অন্তরালে আছে এক বৃদ্ধা ও ক্ষয়রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধের কাহিনী। বৃদ্ধা যক্ষ্মা রোগের কারণে তার স্বামীকে খাটে শুতে দেয় না। গল্পের উপসংহারে লেখক বলেছেন, ‘সেই অতৃপ্ত আত্মা যাকে তার দুর্দান্ত স্ত্রী কোন ক্রমেই ব্যাধির ভয়ে খাটের ওপরে জীবিত অবস্থায় শুতে দেয়নি, সে কি আজ তৃপ্ত হয়েছে? না, এখনও সে ওই খাটের পেছনে প্রতি রাত্রে ঘুরে ঘুরে মরে- কাউকেও ওর ওপর শুতে দেবে না বলে?’ গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। পরিশেষে বলা যায় যে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও বিশ্বজগৎ সম্পর্কে অনন্ত বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা শিশুমনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিশুমনেও আমৃত্যুই এই বিস্ময় কাজ করেছে। তাই তার কিশোর গল্পগুলেতেও ফুটে উঠেছে এসব জিজ্ঞাসা আর জীবনের অভিজ্ঞতা।
×