ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সঞ্জয় সরকার

নেত্রকোনার বাউল কবি

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

 নেত্রকোনার বাউল কবি

বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, পালা, ঢপ, কিচ্ছা, ঘাটু ও কবিগানসহ লোকসঙ্গীতের অসংখ্য উপাদানে সমৃদ্ধ জনপদ নেত্রকোনা। বিখ্যাত লোকসাহিত্য সংগ্রাহক চন্দ্র কুমার দে, সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী ও রওশন ইজদানী প্রমুখ- এ মাটিরই সন্তান। চন্দ্র কুমার দে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ তথা পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকেই ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র অধিকাংশ পালাগান সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তীতে সেগুলো কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় এবং বিশ^সাহিত্যে ঝড় তোলে। বলাবাহুল্য, পালাগান ব্যতীত এ অঞ্চলের আর কোন উপকরণের দিকে দীনেশ চন্দ্র সেনের মতো বড় মনীষীদের চোখ পড়েনি। যদি তা হতো- তবে অন্যান্য লোকসঙ্গীত-উপকরণগুলোও বিশ্ব সাহিত্যের আলোচনায় স্থান পেত- তা নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়। চন্দ্রকুমার দে, সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী বা রওশন ইজদানীর মতো না হলেও স্থানীয় কিছু সংগ্রাহক বিচ্ছিন্নভাবে নেত্রকোনার লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির নানা উপাদান-উপকরণ সংগ্রহের কাজ করে চলেছেন। তাদেরই একজন হামিদুর রহমান। মফস্বলবাসী ও প্রবীণ এ লেখক খুব নীরবে-নিভৃতে নিজ অঞ্চলের সংস্কৃতি-সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। অতি সম্প্রতি অয়ন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘নেত্রকোনার বাউল কবি’ নামে একটি বই। শিরোনামে বাউল-কবিদের কথা উল্লেখ থাকলেও তিনি শুধুমাত্র বাউলের গ-িতে আটকে থাকেননি। পাশাপাশি স্থানীয় কবিয়াল বা জারি, রামমঙ্গল ও পালাগানের বয়াতীদের কথাও বর্ণনা করেছেন। তুলে এনেছেন প্রখ্যাত কিছু লোকসঙ্গীত শিল্পীর জীবনবৃত্তান্তও। মোট ৫১ জন লোক-সাধকের জীবন-পরিচিতি স্থান পেয়েছে বইটিতে। বাউলদের মধ্যে রয়েছেন : বাউল-কবি রশিদ উদ্দিন, উকিল মুনশি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, ফকির চান, করম শাহ, মিরাশ উদ্দিন, শ্রীনাথ, দীন শরৎ, ইদ্রিস মিয়া, জালাল উদ্দিন খাঁ, চান মিয়া, মিরাজ আলী, আব্দুল মজিদ তালুকদার, আব্দুস সাত্তার, খেলু মিয়া, খোরশেদ মিয়া, আলী হোসেন সরকার, আবেদ আলী, প্রভাত সূত্রধর, সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ। আবার কবিয়ালদের মধ্যে রয়েছেন : তারাচাঁদ, লোচন কর্মকার, বিজয় নারায়ণ আচার্য, লাল মাহমুদ, মদন মোহন আচার্য প্রমুখ। জারি, পালা বা কিচ্ছাগানের বয়াতিদের মধ্যে যাদের নিয়ে আলোচনা করেছেনÑ তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ আব্দুল হেকিম বয়াতী, আব্দুল জব্বার বয়াতি, আব্দুল কদ্দুছ বয়াতি, শান্তু বয়াতি ও হাশেম বয়াতি প্রমুখ। বাংলার দ্বিতীয় নারী কবি সুলা গাইনকে নিয়েও একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা আছে বইটিতে। এছাড়াও আছে রামমঙ্গলের গায়েন বিভা চক্রবর্তী, প্রয়াত লোকসঙ্গীত শিল্পী বারী সিদ্দিকীসহ বেশ ক’জন গীতিকার এবং এবং শিল্পী-সাধককে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। এসব বাউল-কবিদের জীবন-কর্ম, দর্শন ও ভাব-বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তাদের রচিত কিছু গানও সংকলিত করেছেন লেখক। বইটি পাঠ করলে নেত্রকোনার সুদূর অতীত থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত খ্যতিমান বাউল-কবি, লোকসঙ্গীত সাধক ও শিল্পীদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা সম্ভব হবে। এছাড়া এসব বিষয় নিয়ে যারা গবেষণা করেন- তারাও অজানা অনেক তথ্যের সন্ধান পাবেন। ৩০২ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বইটির মূল ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার। তিনি লিখেছেন- ‘হামিদুর রহমান যেমন অন্যদের কাছ থেকে আলো নিয়ে নিজের প্রদীপটিকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন, তেমনই উজ্জ্বলতর প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্বই বর্তাবে তার পরবর্তী আলোচক ও গবেষকদের ওপর।’ বইটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। অফসেট কাগজে মুদ্রিত বইটির দাম ধরা হয়েছে ৪৫০ টাকা।
×