ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায়যাত্রায় শ্রদ্ধা ভালবাসায় সিক্ত টুটুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

  বিদায়যাত্রায় শ্রদ্ধা ভালবাসায় সিক্ত টুটুল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শবদেহটি ঘিরে সবাই মিলে গাইল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সেই গানের সুরের সঙ্গে কফিনে মুড়িয়ে দেয়া হলো লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। যে পতাকার জন্য তিনি অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না পেলেও বিদায়যাত্রায় এভাবেই শুভাকাক্সক্ষীদের দেয়া সম্মানে সিক্ত হলেন সাইদুল আনাম টুটুল। সহযোদ্ধা, স্বজন, অনুরাগী ও সতীর্থদের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় শেষ বিদায় নিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র ও নাট্য নির্মাতা এবং এদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের নির্ভীক সৈনিক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিভৃতচারী এই গুণীজনকে প্রদান করা হয় নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি। চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, শিক্ষাবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশ নেয় এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন পর্বে। তারা বলেছেন সাইদুল আনাম টুটুলের দেশপ্রেম ও শিল্পপ্রেমের কথা। সকালের শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে বাদ যোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানাজা। এর পর শিল্পীকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। আজ শুক্রবার বাদ আসর সাইদুল আনাম টুটুলের আত্মার শান্তি কামনায় শান্তিনগরের বাসায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ২৫ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হবে নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান। বেলা ১১টায় বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে সাইদুল আনাম টুটুলের মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শবদেহটি রাখা হয় গগন শিরীষ বৃক্ষছায়ায়। আর পাশের আরেকটি বৃক্ষতলে খোলা হয় শোকবই। শ্রদ্ধানুষ্ঠানে মরদেহের পেছনে দাঁড়ানো টুটুলের স্ত্রী অধ্যাপক ড. মোবাশ্বেরা খানম এবং দুই মেয়ে ঐশী আনাম ও অমৃতা আনামের চোখের কোল গড়িয়ে ঝরেছে বেদনার জল। অভিব্যক্তিতে মিশেছিল প্রিয়জনকে হারানোর শূন্যতা। পরিবারের এই তিন সদস্যের বেদনা ছুঁয়ে গেছে অন্যদের মাঝেও। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেসব শুভাকাক্সক্ষী ভালবাসা জানিয়েছেন টুটুলকে। শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সাইদুল আনাম টুটুলের স্ত্রী অধ্যাপক ড. মোবাশ্বেরা খানম বলেন, টুটুলকে কখনও স্বামী হিসেবে দেখিনি। সে ছিল আমার বন্ধু। আমাদের সম্পর্কটা এমনই ছিল। আজ তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরেকটি নিদারুণ সত্য প্রকাশিত হলো। সৃজনশীল মানুষরা জীবিত অবস্থায় মূল্যায়িত হন না। মূল্যায়িত হন মৃত্যুর পর। এই মানুষটি শিল্পের জন্য কখনও নৈতিকভাবে আপোস করেননি। শিল্প সৃজনের আকাক্সক্ষায় অনেক সময় অর্থকষ্টে ভুগেছেন। অর্থ সঙ্কটের কারণে সৃজনশীল তাড়নার সবটুকু প্রকাশ করতে পারেননি। তার অসমাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কালবেলা’ সম্পন্ন করার দায়িত্বটি এখন বর্তেছে আমার ওপর। কিন্তু আমি জানি না, তার মতো করে সেটা করতে পারব কিনা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাইদুল আনাম টুটুলের চলচ্চিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা। অন্যদিকে চলচ্চিত্র সম্পাদনাতেও ছিলেন অসাধারণ। অনেকদিন পর কালবেলা নামের একটি নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্পনির্ভর চলচ্চিত্রটির ৯০ শতাংশ কাজ শেষও করেছিলেন। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন প্রথম ছবি ‘আধিয়ার’। নির্মাণ করেছিলেন নাল পিরানের মতো জীবনধর্মী নাটক। এভাবেই সৃষ্টির মাধ্যমে টুটুল বলেছেন মানুষ, সমাজ ও জীবনের কথা। মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, দেশকে ভালবাসা একজন শিল্পী চলে গেলেন। দেশপ্রেমিক এই মুক্তিযোদ্ধা অনেক গুণে গুণী ছিলেন। পাপেট নিয়ে আমার সঙ্গে তার অনেক কাজ রয়েছে। পাপেটে চমৎকার করে দিতে পারত। অভিনয়টাও দারুণ করত। কিশোর বয়সে রক্তকরবী নাটকে তার অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালিত্বের চেতনার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল তার শিল্পজীবনের। সেই দায়বোধ নিয়ে কাজ করতে করতেই তিনি চিরবিদায় নিলেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আমার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছিলেন। যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে অপেক্ষার মাঝেই তিনি চলে গেলেন। সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, কিশোর বয়স থেকে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক। নির্মাতার বাইরেও অভিনেতা হিসেবে সে খুব বড় ছিল। তবে অভিনয়ের চেয়ে নির্মাণের দিকেই তার ঝোঁকটা বেশি ছিল। সেখানে তিনি দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। আধিয়ার ছবিটি দেখলে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রামেন্দু মজুমদার বলেন, তার প্রতিটি কাজের মধ্যেই ছিল পরিচ্ছন্নতা। সেখানে থাকত সামগ্রিকতা। তার শিল্প সৃজনে সামগ্রিকতা পাওয়া যেত। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী বলেন, সে ছিল আমার সহযোদ্ধা। শিল্পের প্রতি নিবেদিত এই মানুষ আমার সব চলচ্চিত্র সম্পাদনা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি কখনও কোন বিষয়ে আপোস করেননি। নৈতিকভাবে খুব শক্ত ছিলেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, এদেশের মুক্তি সংগ্রামের নিরলস যোদ্ধা ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে রাজপথের মিছিলে দেখা যেত তার মুখ। মিতভাষী ও নির্ভীক মানুষটি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও অংশ নিয়েছেন। একাত্তরের আট নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ওই সেক্টর কমান্ডারের তালিকায় এখনও তার নামটি রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছি। শেষ জীবনে তার খুব ইচ্ছা ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নামটি তালিকাভুক্ত করার। এই মানুষটি তার জীবনের আদর্শকে বহন করেছেন শিল্পের আশ্রয়ে। দেশপ্রেম থেকেই সূর্য দীর্ঘল বাড়ি কিংবা ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। জীবন থেকে বিদায় নিলেও কালবেলা চলচ্চিত্রটি দেখে আমরা তার সৃজনশীল সৃষ্টিশীলতার উদ্যাপন করব। কারণ, এই শিল্পের ভুবনে আমাদের অনেকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার ভূমিকা। রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে আমরা এক সঙ্গে পথ চলেছি। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘ঘুড্ডি’র মতো কালজয়ী ছবি সম্পাদনা করেছেন টুটুল। তিনি শুধু নির্মাতা বা মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যার সঙ্গে তর্ক করা যেত, ঝগড়া করা যেত এবং ভালবাসা যেত। মোরশেদুল ইসলাম বলেন, আমার চলচ্চিত্র জীবনের শুরুটা হয়েছিল তার হাত ধরে। আমার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগামী’র সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। সেখানে অনেক কিছুই শিখেছি। তিনি ছিলেন এ দেশের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সম্পাদক। শহীদ মিনারে এক মিনিট নীরবতা শেষে সাইদুল আনাম টুটুলের মরদেহ ঢেকে দেয়া হয় লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায়। এ সময় তার বন্ধু-স্বজনরা কণ্ঠে ধারণ করেন জাতীয় সঙ্গীত। এর পর বাদ যোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে সাইদুল আনাম টুটুলকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। সাইদুল আনাম টুটুলকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে আসেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন রামেন্দু মজমুদার, নির্মাতা সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী, নাট্যজন আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, অভিনয় শিল্পী কেরামত মওলা, রাইসুল ইসলাম আজাদ, তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ম হামিদ, নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, অভিনেতা ও নির্মাতা সালাউদ্দিন লাভলু, চঞ্চল চৌধুরী, লুৎফর রহমান জর্জ, আজাদ আবুল কালাম, ব্যান্ডসঙ্গীত শিল্পী ফুয়াদ নাসের বাবু, কণ্ঠশিল্পী সুমনা হক, নাট্যকার মাসুম রেজা, বৃন্দাবন দাস, নৃত্যশিল্পী আমানুল হক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক আশরাফুল আলম, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, নারী উদ্যোক্তা কণা রেজাসহ অনেকে। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচ্যনাট, আরণ্যক, ঢাকা থিয়েটার, শিল্পকলা একাডেমি, চ্যানেল আই, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ, মুভ্যিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, কালবেলা পরিবার, শর্ট ফিল্ম ফোরাম, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র সমালোচক পর্ষদ, ¯্রােত আবৃত্তি সংসদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
×