ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

১৫৭ দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ

ওষুধ শিল্পের বিস্ময়কর উত্থান, রফতানি সাফল্যে ‘বর্ষপণ্য’

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

  ওষুধ শিল্পের বিস্ময়কর  উত্থান, রফতানি  সাফল্যে ‘বর্ষপণ্য’

রহিম শেখ ॥ গত ১০ বছরে ওষুধ রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় এসেছে ১০ কোটি ডলার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে ওষুধ খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০০ কোটি ডলার। স্থানীয়ভাবে দেশের চাহিদার প্রায় শতভাগ উৎপাদন করে রফতানি আয়ে বিশাল অবদান রাখছে এই খাত। এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্ববাজারেও। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৫৭টি দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। দেশগুলোও যেনতেন নয়। তালিকায় আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ পৃথিবীর বড় বড় দেশ। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করায় এ সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানিতে বিশেষ শর্ত শিথিলের সুবিধাভোগী দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ হিসেবে ওষুধ রফতানি করে। জানা যায়, বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যাত্রা শুরু হয় পঞ্চাশের দশকের শুরুতে। একাত্তরে স্বাধীনতার কিছু দিন পর বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। তখন সিংহ ভাগই নির্ভর করতে হতো বৈদেশিক আমদানির ওপর। ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি হয়। এর ফলে বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে দেশী শিল্প মুক্তি পায়। পরবর্তী সময়ে ‘ওষুধ নীতি ২০১৬’ জারি করা হয়। এরপর ওষুধ শিল্পের অগ্রযাত্রা শুধুই গল্পের মতোই। বর্তমানে দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করেও বিশ্বের ১৫৭টি দেশে মানসম্মত ওষুধ রফতানি হচ্ছে। বিশ্বে বর্তমানে ওষুধের রফতানি বাজার ১৭০ বিলিয়ন ডলারের। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ১০ শতাংশ বাজার ধরা গেলে এ খাতে রফতানি আয় দাঁড়াবে ১৭ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। দেশের ওষুধের গুণগত মান ভাল এবং অন্য দেশের তুলনায় দাম কম হওয়ায় এটা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য সরকারের নজরদারি বাড়ানো একই সঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তারা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছর এ খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছর এ খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের ওষুধ রফতানি হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ওষুধ রফতানিতে আগের বছরের ৭ কোটি ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৮ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৯১ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ওষুধ রফতানি হয়েছে ৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। ওষুধ শিল্প মালিকদের মতে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বের ছাড়ের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও ওষুধ শিল্প বিকাশে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা আর বিশ্ববাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ওষুধ রফতানিতে এশিয়ার শীর্ষে উঠে আসবে বাংলাদেশ। এদিকে ওষুধ শিল্প সমিতি বলছে, রফতানি আরও বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ রফতানির অনুমোদন পেয়েছে। ফলে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ রফতানির দরজা খুলছে। এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব কারখানায় ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও অনেকগুণ বেড়েছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং দক্ষ ফার্মাসিস্টদের সহায়তায় বর্তমানে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ওষুধও দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। ওষুধ শিল্প সমিতির সূত্রে জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির পরিমাণ ক্রমে বাড়ছে। স্বল্প দামে আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ সরবরাহের সক্ষমতাই এ দেশের ওষুধ শিল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ওষুধ উৎপাদন করছে। সব মিলিয়ে ভবিষ্যতে ওষুধ শিল্প দেশের রফতানিমুখী শিল্পের শীর্ষে অবস্থান করবে। তাই রফতানি আয় বাড়াতে সরকারের আরও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এছাড়া বর্তমানে ওষুধ রফতানিতে এশিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। তারা নানা ধরনের রফতানি সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের এ ধরনের সুবিধা দিলে ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে সময় লাগবে না। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে ওষুধ রফতানি ট্রেড রিলেটেড এ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তি বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এ চুক্তির আওতায় রফতানিতে শর্ত শিথিল হওয়ায় স্বল্পন্নোত দেশগুলো উন্নত দেশে সহজ শর্তে ওষুধ রফতানি করতে পারে। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি তুরস্ক, কুয়েত, শ্রীলঙ্কা, বেলারুশ, দক্ষিণ আফ্রিকা বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানির চুক্তি করেছে। লাইসেন্সিং চুক্তি করে বাংলাদেশের কারখানায় উৎপাদন করে ওষুধ নিতে চায় জাপানী উদ্যোক্তারাও। বিশ্ব বাজারে আমাদের কদর বেড়েছে উল্লেখ করে ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব বলেন, পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে আমাদের ওষুধ রফতানি করছে। আমরা আশা করছি ওষুধ রফতানি করে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পোশাক খাতের কাছাকাছি চলে যেতে পারব। বর্তমান বাজারে রফতানি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন বাজার ধরতে মনোযোগ দিচ্ছে সবাই। ওষুধ শিল্পকে ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা ॥ দেশের রফতানি আয় বাড়াতে সরকার কয়েক বছর ধরে বর্ষপণ্যের ঘোষণা দেয়। সেই হিসেবে ওই সব পণ্যের সমস্যা চিহ্নিত করে এর মান উন্নয়নে নীতি সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এর ফলে বর্ষপণ্যের মান উন্নয়নের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর চামড়াকে বর্ষপণ্য হিসেবে ১৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়। চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওষুধ শিল্পকে ২০১৮ সালের ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করেন। শিল্পপার্কের ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন, উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ॥ গত নবেম্বরে দেশের প্রথম ওষুধ শিল্প পার্ক এ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট এপিআই শিল্প পার্কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০ একর জমির ওপর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ৩৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় এই ওষুধ শিল্প পার্কটি। ওষুধ শিল্প পার্কের উদ্বোধনীর মাধ্যমে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×