ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে এক ডজনের বেশি নির্দেশনা

পিছিয়ে পড়ছে দুই কৃষি ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

পিছিয়ে পড়ছে দুই কৃষি ব্যাংক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যবসা পরিচালনার বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে পড়েছে সরকারী মালিকানাধীন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বর্তমানে ব্যাংক দুটির অবস্থা অনেকটাই নাজুক। বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি, পুঞ্জীভূত লোকসান, খেলাপী ঋণের উচ্চ হার, শীর্ষ-২০ খেলাপী থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নগদ আদায় না হওয়া, লোকসানি শাখা বৃদ্ধি, উচ্চ সুদবাহী আমানতের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা, ব্যাংক কোম্পানি আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী দাখিল করতে না পারা, সিবিএস বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনস যথাযথভাবে বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতাসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংক দুটির পারফর্মেন্স সন্তোষজনক নয়। ব্যাংক দুটির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সম্পাদিত এমওইউর আওতায় সম্প্রতি এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। ওই বৈঠকে উপস্থাপিত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোকে যেসব টার্গেট দেয়া হয়েছিল তার বেশিরভাগ পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে তারা। এতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংকও। তাই ব্যাংক দুটির আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে এক ডজনের বেশি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ব্যাংক দুটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির বক্তব্যে বৈঠকে গবর্নর ফজলে কবির ব্যাংক দুটির খেলাপী ঋণ আদায়ে গুরুত্বারোপ করেন। এজন্য তিনি বিদ্যমান মামলা নিষ্পত্তি এবং পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনসহ খেলাপী ঋণ হ্রাস করার যেসব পদ্ধতি আছে, তা কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। এছাড়া ব্যাংক দুটিকে বিনিয়োগমুখী ব্যাংক উল্লেখ করে কৃষি ও এসএমই ঋণ বিতরণের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বিকেবি ও রাকাব যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তার প্রশংসাও করেন গবর্নর। মূলধন ঘাটতি ॥ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষে বিকেবির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। তবে রাকাবের মূলধন ঘাটতি বিকেবির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। এর পরিমাণ ৬৪৫ কোটি টাকা। বৈঠকে ব্যাংক দুটির মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমেও পূরণ করার পরামর্শ দেয়া হয়। খেলাপী ঋণ ও আদায় পরিস্থিতি ॥ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বিকেবি ও রাকাবের খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা; যা ব্যাংক দুটির মোট বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সভায় জানানো হয়, বিকেবি পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় খেলাপী ঋণ ৩৮১ কোটি টাকা হ্রাস করতে সক্ষম হলেও রাকাবের বেড়েছে প্রায় ১০৪ কোটি টাকা। সভায় বিকেবির চেয়ারম্যান জানান, খেলাপী ঋণ আদায়ের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মার্চ থেকে প্রতিদিন শাখাওয়ারি খেলাপী ঋণ আদায়ের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে, যার প্রভাবে খেলাপী ঋণ হ্রাস পেয়েছে এবং আদায় ত্বরান্বিত হচ্ছে। আমানত পরিস্থিতি ॥ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সমঝোতা স্মারকে তহবিল ব্যয় ২ শতাংশ ও স্থায়ী আমানত ১০ শতাংশ হ্রাসের শর্ত দেয়া থাকলেও জুন পর্যন্ত বিকেবির এগুলোর পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এমওইউর শর্তের পরিপন্থী। এছাড়া ব্যাংকটির মোট আমানতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এখনও উচ্চ সুদবাহী। উৎপাদনশীলতা ॥ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে বিকেবি লোকসানে ছিল। তবে রাকাব কিছুটা মুনাফায় ছিল। বিকেবির এ সময় লোকসান হয়েছে ৬২৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর রাকাবের মুনাফা হয়েছে ১০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। তবে ব্যাংক দুটি বিগত বছরের শ্রেণীকৃত ঋণ পুনঃতফসিলের ফলে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত এ্যাড ব্যাক পদ্ধতিতে স্থানান্তরের মাধ্যমে মুনাফা হিসেবে প্রদর্শন করেছে। এ বিষয়ে রাকাবের পক্ষ থেকে সভায় জানানো হয়, কেবল যেসব ঋণ আদায় হয়েছে, সেসব ঋণের বিপরীতে থাকা প্রভিশন সমন্বয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এমওইউ অনুযায়ী বিকেবির ২০ শতাংশ তথা ৩০টি লোকসানি শাখা হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু জুন পর্যন্ত তা হ্রাস না পেয়ে উল্টো ১৬৯টি শাখা নতুন করে লোকসানে পরিণত হয়েছে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ॥ রিস্ক ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে ব্যাংক দুটির দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে ওই সভায়। এ বিষয়ে বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ছয়টি কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনসহ বিকেবিতে বিদ্যমান ছিল; তবে এর হালনাগাদ ছিল না। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে সবগুলো সেগমেন্টের হালনাগাদ গাইডলাইনসের কপি বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করা হবে বলে তিনি সভাকে অবহিত করেন। আর্থিক বিবরণী দাখিল ॥ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যে ব্যাংক দুটি নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে পারেনি। এ বিষয়ে বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সভায় জানান, ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে না পারা এবং দক্ষ জনবলের অভাবে যথাসময়ে আর্থিক বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করা সম্ভব হয়নি।
×