ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা

নির্বাচন ও নারী ভোটারদের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচন ও নারী ভোটারদের প্রত্যাশা

বাংলাদেশের নারীরা আজ স্বাবলম্বী। তারা আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার কৌশলও শিখেছে। যে কোন সমস্যার মোকাবেলা করতে পারে দৃঢ়ভাবে। আপন মহিমায় মহিমান্বিত করে তুলতে সক্ষম নিজের জীবনকে নিজস্ব চিন্তাচেতনা আর কৃতকর্মের মাধ্যমে। অন্যদিকে অর্থনীতির মূলধারায় পূর্ণ অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা, যে কোন চ্যালেঞ্জমূলক কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহী হওয়া, পরিবারকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন, রাষ্ট্রীয় যে কোন কাজে পুরুষের মতো সমান সুযোগ লাভের অধিকারী বর্তমান নারীসমাজ। ৩০ ডিসেম্বর (২০১৮) অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এই নারী সমাজের রয়েছে স্বতন্ত্র প্রত্যাশা। নারীসমাজের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকা এবং নির্বাচনোত্তর তারা নিরাপদে ও সহিংসতামুক্ত জীবন পরিচালনায় সক্ষম হবে- ভোটকে কেন্দ্র করে এটাই তাদের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে মাত্র ২ জন নারী প্রার্থী ছিলেন; সেখানে ২০১৮ সালে ৬৮ জন নারী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছেন। ৪৭ বছর বয়সী এ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে ২৫ বছরই নারী দায়িত্ব পালন করেছেন। এবারের সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটারের মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৬ জন। সর্বমোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন। পুরুষের সংখ্যা ৫ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ১০৫ জন। অর্থাৎ নারী-পুরুষ ভোটারদের সংখ্যার ব্যবধান ৮ লাখ ৮১ হাজার ৮২৯ জন। আর পুরুষ ও নারী ভোটারের অনুপাত ৫০.৪২ : ৪৯.৫৮। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৬ লাখের অধিক। এর মধ্যে নারী ৭ কোটি ৪৭ লাখ এবং পুরুষ ৭ কোটি ৪৯ লাখ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮-এ প্রথমবারের মতো ছবিসহ তৈরিকৃত ভোটার তালিকায় পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি ছিল। ভোটার ছিল মোট আট কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার তিনজন। এর মধ্যে নারী ছিল চার কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮২০ জন এবং পুরুষ ভোটার তিন কোটি ৯৭ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৬ জন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৬ ভোটারের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল চার কোটি ৫৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৯৮ ও পুরুষের সংখ্যা ছিল চার কোটি ৬১ লাখ ২২ হাজার ৪৬৯ জন। অপর এক হিসাবে এবারের জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৪১টি জেলার ১০১টি আসনেই পুরুষের তুলনায় নারী ভোটার বেশি। এর মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি জেলার ১২৯ আসনের মধ্যে ৬৩টি আসনেই নারীর তুলনায় পুরুষ ভোটার কম। অন্যদিকে ২২টি জেলার কোন আসনেই নারী ভোটার পুরুষের তুলনায় বেশি নয়। তবে কয়েকটি এলাকায় পারিবারিক ও সামাজিক কারণে নারীদের অন্তর্মুখী অবস্থান থাকলেও কিংবা ভোটার না হলেও তারা এখন তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার। দুই. বাংলাদেশে মোট নারী-পুরুষ ভোটারের অনুপাত কাছাকাছি হলেও সংখ্যায় দেশের বেশ কিছু জেলায় নারী ভোটাররা পুরুষের তুলনায় এগিয়ে আছেন। নারী ভোটারের সংখ্যা যেসব জেলায় বেশি সেগুলো হচ্ছে- বরগুনা, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, গাইবান্ধা, হবিগঞ্জ, জয়পুরহাট, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, মানিকগঞ্জ, মেহেরপুর, নওগাঁ, নড়াইল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, রংপুর, শেরপুর ও টাঙ্গাইল। অবশ্য পার্বত্য এলাকায় নারী ভোটার পুরুষদের চেয়ে বেশি না হলেও তাদের উপেক্ষা করা অসম্ভব। রাঙ্গামাটি-২৯৯ আসনটি বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, কাউখালী, নানিয়ারচর, কাপ্তাই, রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি ও রাঙামাটি সদর ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১৮ হাজার ২৪৮ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৫৩ জন এবং পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৫ জন। খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৪ জন এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৬ জন। নতুন ভোটার হওয়ায় ৬১ হাজারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী। অন্যদিকে বান্দরবান জেলায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩৫৯ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ৯২ হাজার ৪১৭ জন এবং নারী ভোটার ৮১ হাজার ৯৪২ জন। অর্থাৎ তিন পার্বত্য এলাকায় নারী ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখেরও বেশি। ইতোমধ্যে এই নারী ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে পাহাড়ে নারীর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবি জানিয়েছিল। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অর্থনীতিতে এবং দেশের উন্নয়নে প্রায় সমানভাবে সম্পৃক্ত। এজন্য এসব নারী কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্র নিরাপত্তা দাবির বিষয়টি যৌক্তিক। প্রতি মাসেই ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতন ও অপহরণের শিকার হয় নারীরা। অনেক নির্যাতনের ঘটনার খবর আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী পর্যন্ত পৌঁছায় না। মূলত দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহসাই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় যাতায়াত করতে না পারা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও সামাজিক সচেতনতার অভাবে পাহাড়ে এসব ঘটনা বেশি ঘটে। এজন্য দরকার পাহাড়ে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। নিরাপত্তা ছাড়াও কোন কোন নারী স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়লে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ফলে পাহাড়ে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃজন ভোটারদের দাবি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি নারী ভোটারদের ভোট পেতে ৫০টি সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি সরাসরি আসনেও নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে দলসমূহ বহু নতুন-পুরনো নারী কর্মী নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। এখন নারীর নিরাপত্তা বিধানে প্রতিশ্রুতি প্রদানের পালা। তিন. ভাবা হচ্ছে, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে পুরুষ ভোটারের তুলনায় নারী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি বেশি দেখা যেতে পারে। অতীতেও দেখা গেছে, নারী ভোটাররা ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকলে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যান। তাই ফলাফল নির্ধারণে বড় ফ্যাক্টর তারা। আবার নারী ভোটারের মধ্যে অনেকেই এবার জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন। নতুন এই ভোটারদের আশা-আকাক্সক্ষা ভিন্ন মাত্রার। ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষিত ও বয়সে তরুণ এসব নারী ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিবেন। তবে গ্রামীণ নারীদের কেউ কেউ হয়তো পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভোট দিতে পারেন। এছাড়া আমার মতো কর্মজীবী নারীরা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজ এলাকায় ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। অবশ্য সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে আমাদের দায়িত্ব পালনও গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেখা দরকার কোন কারণে আমরা যেন হয়রানির শিকার না হই। আমাদের নিরাপত্তা বিধানে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর থাকতে হবে। লেখক : গবেষক
×