ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

বিএনপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা কি পরিকল্পিত?

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

বিএনপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা কি পরিকল্পিত?

ভাগ্যিস, বাংলাদেশে ‘খনা’ নামের এক অসাধারণ মেধাসম্পন্ন সমাজ বিশ্লেষক জন্মগ্রহণ করে বাঙালীর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সমাজ শিক্ষা দিয়ে চলেছেন, যেগুলো আমরা এখনও কোন ঘটনার যথার্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাঁর দেয়া প্রবচন-বচনগুলো ব্যবহার করে চলেছি! এখানেও শুরুতেই মনে পড়ছে তারই বচন- ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ করার হীন প্রবণতার কথা! আবারও পুনরুক্তি করছি সেই ২০০৮-এর নির্বাচনের পর বিএনপির ছাত্রদল ক্যাডারদের প্রতি তারেক রহমানের উপদেশটি, ‘আর বিএনপিতে থাকতে হবে না, সবাই ছাত্রলীগে ঢুকে ছাত্রলীগ হয়ে যাও, তারপর মারামারি-সংঘর্ষ কর, দোষ হবে ছাত্রলীগের!’ এটাই নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের উদাহরণ। এটা বলতে বাধা নেই যে, ছাত্রলীগের সব নেতা-সদস্য ফেরেশ্তা নয়, তাদের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক সুবিধাবাদী, অর্থলোভী, স্বার্থসর্বস্ব এবং সংখ্যালঘুদের জমি দখল করা ব্যক্তি রয়েছে। তবে, নিজের ওপর হামলা নিজের দলের বা ছাত্রলীগে প্রবেশ করা ছাত্রদল ক্যাডার দিয়ে করিয়ে তারপর আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা- এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র যা এর আগেও অনেকবার হয়েছে! এ ধরনের ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা করার কোন ইতিহাস, সাক্ষ্য প্রমাণ আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের মধ্যে কখনও দেখা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন, হত্যাকা-, বাড়িঘর-গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করার সহিংস ঘটনা বিএনপি-জামায়াত সংঘটন করেছিল, সে সময় বিএনপি ক্যাডারদের হাতে প্রায় বাইশ হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নিহত হয়েছিল। যখন ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ ভোটে জিতে সরকার গঠন করেছিল, তখন জনগণ, এমন কি বিএনপির নেতানেত্রী ভেবেছিল এবার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ তাদের ওপর পাঁচ বছর যাবত চালিয়ে যাওয়া নির্যাতন, হত্যাকা-ের বদলা নেবে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, বদলা নেয়া দূরে থাক, মহাজোট সরকার জানুয়ারিতে সরকার গঠন করার পরপর ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর-এ বিদ্রোহ সংঘটন করে পরাজিত মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি-বিএনপি-জামায়াত জোট! অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত প্রত্যেক নির্বাচনে, তার আগে, পরে, বিজয়ী হোক বা পরাজিত হোক-ষড়যন্ত্রমূলক নাশকতা সংঘটন করেছে! এবারের নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। এবারের নিজ দলের মিছিল, গাড়িবহরে নিজেদের উদ্যোগে হামলা আবার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যা ষড়যন্ত্রটি করার নেপথ্য উদ্দেশ্য কি হতে পারে, তা জনগণ নিশ্চয় উপলব্ধি করেছে- ১. বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রথম উদ্দেশ্য অবশ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সরকারের অধীনে নির্বাচন যে নিরপেক্ষ হয় না- সেটি প্রমাণ করার জন্য প্রতিদিন হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা কম, বেশি ঘটানোর পর প্রতিদিন নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রদানের রুটিন কাজটি করে যাওয়া হচ্ছে! ২. বর্তমান নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকার কারণে এই নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করার লক্ষ্যে ঐক্যজোট ও বিএনপি একজোটে কাজ করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাছাড়া, বিএনপির নেতা জিয়া, নেত্রী খালেদা এবং তারেক তাদের শাসনামলে যে কাজটি একই রকমভাবে করে গেছে, তা হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি-নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা! শুরুটা জিয়া ‘ইয়েস’, ‘নো’, ভোটের নির্বাচন দিয়ে শুরু করেছিল! স্মরণ আছে, একটি ‘নো’ ভোট দেয়ার মানসে নির্বাচনের দিন সকালে সবসময়ের মতো পাড়ার উদয়ন স্কুলে ভোট দিতে গিয়ে দেখি স্কুল বন্ধ, কেউ জানে না আমাদের পাড়ার ভোটকেন্দ্র কোথায়! কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্রী না হওয়ার ফলে আমি, আমার স্বামী খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভোটকেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিপরীতে অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে! অত দূরে, রাস্তায় রিক্সা, অন্য কোন যান না থাকায় দু’চারজন যারা ভোট দেবে ভেবেছিল, তারা না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আমি মাঠ পার হয়ে হেঁটে ভোট দিতে যাব, অগত্যা আমার স্বামী আমার সঙ্গে না গিয়ে পারল না! ঘেমে ক্লান্ত হয়ে মাঠ পেরিয়ে যখন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে পৌঁছলাম, তখন আমাদের দেখে ভোট নেয়ার দুটি লোক ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, বলল, ভোট দিতে এসেছেন! আমি বললাম, কেন, ভোট দেব না কেন? এক ব্যক্তি ব্যালট পেপার দিল, আমরা ‘নো’ সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলে দিলাম। এটা ঠিক, ভোট দিতে আর কোন ব্যক্তি গেছে, এমন দেখিনি। তবু তখনও বুঝিনি, সব ব্যালট পেপারে ‘ইয়েস’ সিল দিয়ে বাক্স ভরার নির্দেশ ছিল! পরে ফল জেনে খুব হতাশ হয়েছিলাম বৈকি, কিন্তু সে সঙ্গে ওই তিনজন স্বদেশের শত্রু ও যুদ্ধাপরাধীদের সুরক্ষাদাতা, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা ও পরম মিত্রদের চিনেছিলাম ও তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে সংবাদে কলাম লিখতে শুরু করেছিলাম! ওই কলামগুলো বাংলাদেশে প্রথম তাদের, বিশেষত জিয়ার, স্বরূপ উদ্ঘাটন করা কলাম যেগুলো পরে ‘সত্য যে কঠিন’ নামে সংকলনভুক্ত হয়েছিল। যা হোক, বিএনপি নানাভাবে প্রমাণ করেছে যে- বিএনপি এবং জামায়াত একই আদর্শে বিশ্বাসী, তাদের শত্রুপক্ষ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে চলা বাংলাদেশ, উন্নত বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সুশাসন বা আইনের শাসন! সুতরাং বিএনপি একদিকে যেমন রেজিস্ট্রেশন বাতিল হওয়া যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের নেতাদের তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক- ধানের শীষ দিয়ে একেবারে কোলে তুলে নিয়েছে, তেমনি নিজেদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না- এই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করে সম্ভবত নির্বাচনের আগের দিন অথবা নির্বাচনের দিন ১১/১২টার মধ্যে নির্বাচন থেকে বিএনপি দলটি নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে অর্থাৎ তারা নির্বাচন বয়কট করবে! কেননা তারা শুধু যে ২০১৪-১৫-এর নির্বাচন বয়কট করেছিল তা নয়, তারা সিটি মেয়র নির্বাচনের দিন বেলা ১১টার দিকে কোন কারণ ছাড়াই নির্বাচন বয়কট করেছিল! এ কথা তো ঠিক যে, বিএনপি নেত্রী খালেদা এবং বিএনপি নেতা-তারেক, দুর্নীতি ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি যারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। তাছাড়া, বিএনপি দলটির পরপর দুইবার নির্বাচন বয়কটের ফলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল হলেও তাতে খালেদা, তারেকের কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই! বিএনপির অস্তিত্ব না থাকলেও তাদের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা- আইএসআই-এর আর্থিক সহায়তায় দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গীগোষ্ঠীর মাধ্যমে চালিয়ে যাবে বলে ধারণা হয়। তা না হলে, ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেন যখন বলেন, আমরা ভোটকেন্দ্র পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করব, তখন শিবিরকর্মী ও জঙ্গীগোষ্ঠী কেন পরিকল্পনা করে তারা ভোট কেন্দ্রের বাইরে নৌকা নিয়ে পাহারা দেবে! আসলে তারা নৌকা নিয়ে আওয়ামী লীগ সেজে হামলা, সংঘর্ষ করে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ম্লান করবে! তারেকের বক্তব্যটি-তোমরা ছাত্রলীগ হয়ে যাও, ওদের ভেতরে ঢুকে হামলা-সংঘর্ষ কর, তাতে ওদেরই বদনাম হবে! এ পথেই জামায়াত-শিবির-জঙ্গীরা হাঁটবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই, জামায়াত-শিবির যদি হয় বিএনপির এক মায়ের পেটের ভাই, তাহলে জঙ্গীদের বাবা তো তারেক রহমান! বাংলাভাই বলে গিয়েছিল ‘ভাইয়া’র প্যাকেট না আসলে এসব কিছু করতে পারতাম না! বিএনপি তার শেষ চালে জামায়াতকে ধানের শীষ দিয়ে সংসদে প্রবেশের দ্বিতীয় সুযোগ দিল, বিরোধী দলের হয়েও সেই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদকে অপবিত্র করার সুযোগ লাভ করছে- এটাও বিএনপির চাল- অর্থাৎ খালেদা, তারেক না থাকলেও যুদ্ধাপরাধীরা তাদের প্রক্সি খেলা খেলবে! এতে যুক্ত হয়েছেন স্বনামধন্য আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও! বাঙালীর জন্য দুঃখ দিনের সমাপ্তি খুব সহজে আসবে বলে মনে হয় না! লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×