ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র শিল্পের অনন্য নাম

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র শিল্পের অনন্য নাম

অবশেষে চলেই গেলেন চলচ্চিত্র শিল্পের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেন। তাকে কেবল চলচ্চিত্র শিল্পের মানুষ বললে ভুল হবে। আরও একাধিক পরিচয়ে তিনি উজ্জ্বল। গত মাসখানেক আগে থেকে দেশের টিভি-পত্রপত্রিকায় তার অসুস্থ হওয়ার খবর অনবরত আসছিল। যদিও সে সব খবরের মধ্যে তার ফিরে পাবার কিছুটা আসাও ছিল। আমজাদ হোসেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অসুস্থ। সুচিকিৎসা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে অধিকতর ভাল চিকিৎসার জন্য গত ২৭ নবেম্বর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাঙ্ককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে কিছুটা উন্নতির খবরও আমরা জেনেছি তার পরিবার থেকে। কিন্তু কি হলো এত চেষ্টা করে! আমজাদ হোসেনকে কী বাধা গেল? এক রকম বিদায় না নিয়েই তিনি চলে গেলেন এই নশ্বর পৃথিবীর মায়ার জাল ছিঁড়ে। অবশিষ্ট থাকল তার শিকর। যা আজ এবং আগামীতে তার নাম ধরে মাটি খুঁড়ে বের হবে এবং তার মতোই বটবৃক্ষ রূপে বাংলা শিল্প-সাহিত্যকে সুশীতল ছায়া দেবে। তিনি এখন অনন্তরাজ্যের অন্তপুরী বসিন্দা। আমজাদ হোসেন ছিলেন একজন আগাগোড়া শিল্পশ্রষ্টা মানুষ। শিল্পের সকল মাধ্যম অর্থাৎ চলচ্চিত্রকে তিনি ভালবেসেছেন হৃদয়ের অন্তঃস্তল থেকে, যে কারণে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা থেকে শুরু করে গান লেখা, অভিনয় করা, সাহিত্য রচনা সবই করছেন নিজেকে উজাড় করে। তার ৭৬ বছর জীবনের পুরোটাই বলতে গেলে দিয়ে গেছেন সৃজনশীল কর্মে। আমাদের এই শিল্পখড়ার দেশে তার মতো মানুষ হয়ত বছর বছর জন্মাবে না। এখন কথা হলো এই নন্দিত মানুষ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম কতখানি ওয়াকিফহাল। হয়ত পুরোটা নয়। যদি হতো তা হলে তার জীবনসায়াহ্নে এসে চলচ্চিত্র কিংবা অন্যান্য শিল্পে এমন দীন দশা তার বা আমাদের দেখতে হতো না। আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট। জামালপুর শহরের উপকণ্ঠে। যদিও আমরা তাকে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে জানি। তবে তার শৈশবের পরিচয় কিন্তু অন্য আমজাদ হোসেনের সন্ধান দেয়। ছোটবেলা থেকে বইপড়া, কবিতা লেখার প্রতি তার ছিল প্রবল অনুরাগ এমনটাই জানা যায় তার অতীত ঘেঁটে। ছোট্ট একটা স্মৃতিকথা উল্লেখ করা যাক। ১৯৬৫ সাল। মেট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কাউকে না জানিয়ে গোপনে কলকাতায় ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি কবিতা লিখে পাঠান। কবিতা প্রকাশের আগেই দেশ পত্রিকা থেকে সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমজাদ হোসেনকে একটি চিঠি পাঠান যেখানে লেখা ছিল- ‘কল্যাণীয়েষু, পুনশ্চ, এই যে তুমি কেমন আছ, কী অবস্থায় আছ জানি না। তোমার কবিতা পেয়েছি। তোমার হাতে/কলমে সরস্বতীর আশীর্বাদ আছে। আমার এই পত্র পাওয়া মাত্রই তুমি কলকাতায় চলিয়া আস। তোমার থাকা-খাওয়া-শিক্ষা সমস্ত কিছুর ভার আমার ওপরে। শুভেচ্ছান্তে সাগরময় ঘোষ।’ বয়সে ছোট আমজাদ হোসেন ভয়ে পরিবারকে বলতে পারেনি, সে কবি হতে, লেখক হতে কলকাতায় যাবে। সে দিন যদি আমজাদ হোসেন সাগরময় ঘোষের লেখা চিঠির কথা রাখতেন তাহলে আজ হয়ত তাকে অন্য শিরোনামে জানতে হতো। যাই হোক তিনি নিজেকে এবং তার জন্মভূমিকে নিরাস করেনি। তার দীর্ঘ ৭৬ বছরের জীবন আমাদের শিল্প-সাহিত্যে অসামান্য অবদান রেখেছে। সিনেমা, নাটক, অভিনয়, গান রচনা এবং সর্বোপরি স্বনামে খ্যাত একজন লেখক আমজাদ হোসেনকে এ দেশের মানুষ খুব কাছ থেকে পেয়েছে। আমজাদ হোসেনও খুব কাছ থেকে এ দেশের মাটি-মানুষকে গভীরভাবে অনুভব করেছেন। বিশেষ করে তার নির্মিত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই কিভাবে সময় এবং সত্যকে তিনি ক্যামেরাবন্দী করেছেন। ‘ভাত দে’ ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ‘দুই পয়সার আলতা’ ‘নয়নমণি’ ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’সহ প্রভৃতি সিনেমায় তার নামকে মানুষের কাছে বড় আপন করে তুলেছে। তার ক্যামেরায় বাংলার অগুনতি মানুষ নিজেদের ছায়া দেখতে পেয়েছে। তিনি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির ভুবনে কিংবদন্তিতুল্য। সিনেমা পরিচালনার পাশাপাশি তার লেখা গান আজ এবং আগামীতে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। বিশেষ করে তার লেখাÑ আছেন আমার মোক্তার/আছেন আমার ব্যারিস্টার, কেউ কোন দিন আমারে তো কথা দিল না, একবার যদি কেউ ভালবাসত, এমন তো প্রেম হয়, কত কাঁদলাম কত সাধলাম, বাবা বলে গেল... প্রভৃতি গানের কথা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর লোকদের গানের তৃষ্ণা মিটিয়েছে। কেবল গান লেখায় আমজাদ হোসেন অবদান উল্লেখ করলে তার পরিচয়ে যোগ হবে অনন্য মাত্রা। তাকে নিয়ে লিখতে হবে অন্য পরিচয়ে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার : একুশে পদক। কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার তার নামকে আলোকিত করেছে। অবশেষে তার এতসব কীর্তি আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় যথাযথ ধারণ করাই গুরুদায়িত্ব। তার দেহ গত হলেও তার নাম এবং কর্ম আমাদের কাছে সব সময় বর্তমান হয়ে থাকবে। ভাল থাকবেন বাংলামায়ের কৃতী সন্তান আমজাদ হোসেন।
×