ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে রাজাকার চাই না

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

সংসদে রাজাকার চাই না

৩০ লাখ শহীদের রক্তের বন্যায় এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আব্রুর বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বরে পূর্ণ হচ্ছে মহান বিজয়ের ৪৭ বছর। বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিজয়ের মাসে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের আরেকটি বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আমরা আশা করব একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলকে ভোট দিয়ে দেশবাসী সংসদের পবিত্রতা রক্ষা করবে। বিএনপির প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন জামায়াত তথা রাজাকারের দল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ২২টি আসনে লড়ছেন আর এতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলেও প্রার্থী। দেশবাসীর উচিত হবে বিজয়ের মাসে তাদের বর্জন করে আরেকটা বিজয় ছিনিয়ে আনা। কোন রাজাকার বা রাজাকারের সন্তানকে আমরা পবিত্র সংসদে আর দেখতে চাই না। এই রাজাকারদের রাজনীতি করার কোন অধিকার পূর্বেও ছিল না, এই বিএনপিই মূলত এদের এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল। আমরা জানি, ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রথম কাজ ছিল সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দেয়া। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সে সময়ের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল মোট ২১টি। এদের মধ্যে মাত্র ৫টি দল জিয়াউর রহমানের নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এই দলগুলো হলো, মুসলিম লীগ, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। বলাবাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণবিরোধী ভূমিকার জন্য ১৯৭২ সালে এসব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কাজেই দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের আমলেই এ দলগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তখন থেকে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান। আর আজ তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমনভাবে জামায়াতিরা বিরোধিতা করেছে একই কায়দায় এদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর জন্য মেতে উঠেছিল কিন্তু বর্তমান সরকার তা করতে দেয়নি। এই ধর্মান্ধদের মাথায় তোলার পরিণাম পাকিস্তান এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ৯ মাসের মরণপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের, জন্ম হয় লাল-সবুজ পতাকার। একটি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনার। অনেক রক্ত, অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের বিজয়। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ এই জগদ্বিখ্যাত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। খুঁজে পায় গেরিলাযুদ্ধের গোপন কৌশল ও দিকনির্দেশনা। তারপরও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সমগ্র জাতি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান বুকে ধারণ করে এবং হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালীর রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দু’লক্ষাধিক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’। প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান, রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে আর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জš§ হয়Ñ সেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এটা সত্য যে, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ অনেকটা সফল হয়েছেন বর্তমান সরকার। জামায়াতের জঙ্গী কর্মকা- এবং জঙ্গীবাদ যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল এর উত্থান ঠেকিয়েও প্রশংসা অর্জন করেছে এ সরকার। আজ জঙ্গী হামলায় জর্জরিত পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, স্বাধীনতা না এলে হয়ত আমাদের অবস্থাও হতো তাদের মতোই। সৌভাগ্য, আমরা এড়াতে পেরেছি সেই পরিস্থিতি। ইতোমধ্যেই সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুট ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় দেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কোটি মানুষের মনে বিরাট আশার সঞ্চার জাগিয়েছে। এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার যারা আমাদের দেশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী, শিশু এবং দেশ প্রেমিক জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, ধর্ম রক্ষার নাম দিয়ে যারা কেড়ে নিয়েছিল মা-বোনদের ইজ্জত, তাদের রক্ষা করার জন্য যারাই মাঠে নামবে তারা কখনই সফল হবে না। এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য যতই দল গঠন করুক না কেন কোন শক্তি আজ পারবে না তাদের রক্ষা করতে। খুবই কষ্ট হয়, যখন দেখি স্বাধীনতার এতটি বছর অতিক্রম হওয়ার পরও পরাজিত শক্তি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সমগ্র জাতির এখন একটাই প্রত্যাশা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার মাটিতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা যুদ্ধাপরাধীদের আর প্রকাশ্যে দেখতে চায় না। বাংলার মাটি ও মানুষ দেখতে চায় না মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারী ওই নরপিশাচদের বংশধরদেরও। বিজয়ের এ মাসে দেশবাসীর প্রতি এই আহ্বান জানাই, আসুন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ভোটের মাধ্যমে বর্জন করে আরেকটি বিজয় ছিনিয়ে আনি। ঢাকা থেকে
×