ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

উদীচীর ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’ যাত্রাপালার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

উদীচীর ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’ যাত্রাপালার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৪২ সাল। বাংলার মৃত্যুপাগল যৌবন সেদিন দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তারা জীবনপণ করে নির্ভীক সৈনিকের মতো আমৃত্যু যুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার জন্য। তাদেরই কিছু কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে উদীচী কেন্দ্রীয় নাটক বিভাগের প্রথম যাত্রাপালা ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’। পালাটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে বুধবার সন্ধ্যায়। মহান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য রচিত এ যাত্রাপালাটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রখ্যাত যাত্রাশিল্পী ও নির্দেশক ভিক্টর দানিয়েল। সহযোগী নির্দেশক হিসেবে রয়েছেন মোফাখখারুল ইসলাম জাপান। যাত্রাপালার এক পর্যায়ে সা¤্রাজ্যবাদী শাসকের প্রলোভনে মত্ত জমিদার তার ¯েœহের নাতি, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূসহ স্বজনদের হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। ইংরেজের বিচারে এই আন্দোলনের মূল নায়ক জমিদারপুত্র মহেন্দ্র (প্রশান্ত) চৌধুরীর দ্বীপান্তর হয়। কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়ার পর কালাপানির নির্বাসন থেকে সে আবার ফিরে আসে প্রিয় জন্মভূমির বুকে। পালায় ইংরেজ সরকারের রায়বাহাদুর খেতাব বাঙালী জমিদার চরিত্র যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি জমিদারের ঘরেই জন্ম নিয়েছে বিদেশী সা¤্রাজ্যবাদী দস্যুর হাত থেকে ভূখ-ের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূর্যসৈনিকরা। তারা ইংরেজের কবল থেকে মুক্ত করে পলাশপুর থানা। তাদের বিশ্বাস, সেদিনের সে সংগ্রাম আগামীদিনের সংগ্রামের প্রেরণা উৎস হিসেবে কাজ করবে। কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ এ যাত্রায় চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এ যাত্রার চরিত্রগুলোর মধ্যে যেমন জন্মভূমি মায়ের মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিত বীরসন্তানরা রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বার্থের মোহে অন্ধ ইংরেজের ক্রীতদাস, রয়েছে ঘরশত্রু বিভীষণের দল। যারা অব্যাহত রেখেছে দেশমায়ের মুক্তিসংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেয়ার কূটকৌশল। দেশপ্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করে চারণকবি মুকুন্দদাস শুরু করেছিলেন ‘স্বদেশী যাত্রা’। উদীচীরও প্রথম পরিবেশনা সেই ব্রিটিশ ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে যাত্রাপালা ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’। উদীচীর ভাষ্য, মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ বিনির্মাণের লড়াইয়ে উদীচী পথ চলছে অবিরাম। সে চলায় নিশ্চয় এটি নতুন মাত্রা যোজনা করবে। যদি আমাদের স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে বর্তমানের তরুণ বন্ধুরা সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজমান স্বার্থপর সা¤্রাজ্যবাদী দেশীয় দালাল, মজুতদার, মুনাফালোভী লুটেরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, তবেই সার্থক হবে বিয়াল্লিশের বিপ্লব, সার্থক হবে উদীচীর এ প্রয়াস। উদীচী মনে করে, আবহমানকাল থেকে বিনোদনের প্রধান অনুসঙ্গ যাত্রাশিল্প বাঙালী সমাজে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের এক অতি প্রাচীন গৌরবময় লোকনাট্যধারা এই যাত্রা। আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান এবং মৌলিক শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ যাত্রা। একাত্তরে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর সবার প্রত্যাশা ছিল এই শিল্প মাধ্যমটি আমাদের সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজে একটি নবজাগরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু পঁচাত্তরের দুঃখজনক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় ইতিবাচক অর্জনগুলোর অবক্ষয়ের পাশাপাশি এই লোকজ সাংস্কৃতিক ধারাটিও উল্টোরথে চলতে শুরু করে। সিপাহী সরকারদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ তত্ত্বাবধান, উদ্যোক্তাদের ঘৃণ্য অর্র্থলোভী মানসিকতা, তথাকথিত প্রিন্সেসদের বেলেল্লাপনা এবং নানাবিধ অশ্লীলতায় এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যমটি ভীষণভাবে কলুষিত হয়ে পড়ে। ফলে, সুস্থ চিন্তার দর্শকরা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। তাই, যাত্রাশিল্পের এই সঙ্কটকালে এগিয়ে আসা অন্যান্য প্রগতিশীল ঘরানার মতো উদীচীরও পবিত্র দায়িত্ব।
×