ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সম্ভাবনার বাংলাদেশ ৪;###;বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য ও বর্জ্য রফতানি

দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে প্লাস্টিক পণ্য

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে প্লাস্টিক পণ্য

রহিম শেখ ॥ দেশে ক্রমেই বাড়ছে প্লাস্টিক পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে রফতানি হচ্ছে সাড়ে ১৩শ’ কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য। শুধু প্লাস্টিক পণ্য নয়, গত বছর বর্জ্য রফতানি হয়েছে অন্তত দেড় শ’ কোটি টাকার। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, স্পেন, কানাডাসহ বিশ্বের ২৩ দেশে সরাসরি যাচ্ছে বাংলাদেশের এই পণ্য। সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও রফতানি হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য। গৃহসজ্জা থেকে অটোমোবাইল, চিকিৎসার সরঞ্জাম কিংবা রফতানিমুখী শিল্পের আনুষঙ্গিক সব পণ্য সবই তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। নজর কাড়ছে প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি প্লাস্টিকের বাহারি খেলনাও। প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের মতে, বর্তমানে দেশে ৫ হাজারের বেশি কারখানায় বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার কয়েক হাজার ধরনের পণ্য উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে প্রায় শতভাগ চাহিদা মেটালেও এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আয় মাত্র এক শ’ ৬০ মিলিয়ন ডলার। বাজার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। এজন্য দ্রুত শিল্পনগরী চালু ও প্লাস্টিক পণ্য আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির দাবি উদ্যোক্তাদের। দূর করতে হবে রফতানিতে নগদ প্রণোদনা পেতে শর্তের বেড়াজাল। শ্রমঘন খাত হিসেবে প্লাস্টিক শিল্পের উন্নয়নে সরকারকে নীতি-সহায়তা বাড়ানোর কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। জানা গেছে, দেশে মূলত প্লাস্টিক শিল্পের যাত্রা ৫০ দশকের শুরুতে। এ সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে প্লাস্টিক শিল্প। ৯০ দশক পর্যন্ত এ দেশে নি¤œমানের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হতো। বিদেশী প্লাস্টিক পণ্যের জন্য দেশীয় বাজার ছিল অবারিত। এখন মানে ও বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্প এতটাই এগিয়েছে- এ শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করেন, পোশাক শিল্পের মতো আনুকূল্য পেলে প্লাস্টিক পণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদন ও রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, দেশে ছোট-বড় কারখানায় প্রায় ১৫ ক্যাটাগরিতে পণ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে পোশাক খাতের জন্য পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, প্লাস্টিক ক্লিপ, বোতাম; খেলনাসামগ্রীর মধ্যে পুতুল, বল, ইয়োইয়ো; গৃহে ব্যবহারের জন্য চেয়ার, টেবিল, ডাইনিং টেবিল, বিভিন্ন ধরনের রেক, ঝুড়ি, বাথটাব, জগ, মগ, ঝুড়ি; অফিসে ব্যবহারের জন্য পেপারওয়েট, স্কেল, টেবিল, বলপেন, ফাইল কভার অন্যতম। কৃষি খাতের জন্য পাইপ, সাইকেলের যন্ত্রাংশের মধ্যে বাম্পার, হাতলের কভার, ব্যাক লাইট, স্পোক লাইট; মাছ ও ডিম রাখার ঝুড়ি; ভিডিও ও অডিও ক্যাসেট, কম্পিউটারের উপকরণসহ প্লাস্টিকসামগ্রী তৈরি হচ্ছে দেশেই। সূত্র মতে, বর্তমানে ২০টি বড় প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক পণ্য বিদেশে রফতানি করছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, স্পেন, কানাডাসহ বিশ্বের ২৩ দেশে সরাসরি যাচ্ছে বাংলাদেশের এই পণ্য। সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও রফতানি হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি। বর্তমান প্লাস্টিক শিল্পের বার্ষিক লেনদেন হচ্ছে ২০/২৫ হাজার কোটি টাকা। রফতানিমুখী এ খাত থেকে সরকার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে থাকে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্লাস্টিক পণ্য থেকে মোট রফতানি আয় আসে ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯৫ হাজার ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্লাস্টিক পণ্য থেকে রফতানি আয় এসেছে ১১ কোটি ৬ লাখ ৯ হাজার ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রফতানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্লাস্টিক রফতানিতে আয় এসেছে ৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ বছর রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ কোটি ডলার। এদিকে কয়েক বছরে বাংলাদেশের খেলনা রফতানির চিত্রটি বেশ আশাবাদী হওয়ার মতো। গত ৫ বছরের ব্যবধানে শিশুদের খেলনা রফতানি ২ হাজার ৭৫ গুণ বেড়েছে। ৫ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৭ হাজার ৬৩৭ ডলারের খেলনা রফতানি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খেলনাসামগ্রী রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে ১২৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে খেলনা রফতানির তালিকায় আছে ট্রাইসাইকেল, ইলেক্ট্রিক বা ব্যাটারিচালিত খেলনা গাড়ি, প্যাডেলচালিত গাড়ি, ইলেক্ট্রিক পুতুল ও সাধারণ পুতুল। সরকারের নীতি-সহায়তা পেলে ২০২১ সালের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্য রফতানি করে ৮ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা। দেশের প্লাস্টিক জগতে আরএফএল, বেঙ্গল, পারটেক্স ও হ্যামকোসহ নামী-দামী কোম্পানিই বিশ্বে প্লাস্টিক পণ্যের বাজারে আস্থা সৃষ্টিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। রফতানিতে প্লাস্টিক শিল্প খাতের অবস্থান ১২তম। এবার রফতানি আয়ের লক্ষ্যে ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্লাস্টিক খাত থেকে ধরা হয়েছে। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কাগজ-কলমে যতটা লেখা আছে, বাস্তবে সরকারের সহায়তার উদ্যোগ আমাদের উদ্যোক্তারা দেখতে পান না। সেই সঙ্গে নতুন কারখানা স্থাপনে অবশ্যই যেন পূরণ করা হয় কমপ্লায়েন্সের সব শর্ত, সেদিকে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। জানতে চাইলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদন ও রফতানিকারক এ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, চাহিদা অনুযায়ী উদ্যোক্তারা মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করায় প্রতিবছরই রফতানির আয়ের পরিমাণ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি যাচ্ছে আমাদের দেশীয় পণ্য। বড় বাজার হতে পারে ভারত ও চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার মাথাপিছু শত কেজি। সিঙ্গাপুরে ১৩০ কেজি। আমাদের দেশেও চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। জসিম উদ্দিন বলেন, প্লাস্টিক শিল্পের বিকাশে এ খাতে কর অবকাশ সুবিধা দিতে পারে সরকার। বিপিজিএমইএর সভাপতি বলেন, সরকারের অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের মতো এ খাতটিতেও নজর দেয়া উচিত। বছরে দেড় শ’ কোটি টাকার প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানি ॥ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক বর্জ্য বিদেশে রফতানি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে ২০১১-১২ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি টাকা। ইপিবির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই থেকে নবেম্বর সময়ে রফতানি হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পিইটি ফ্লেকস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএফএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে বোতল কুচি উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা ৮শ’র বেশি। ২০১০ সালে ৩০ হাজার টন পিইটি প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানি হয়েছিল। ২০১৩ সালে বেড়ে হয় ৪৫ হাজার টন। বর্তমানে প্রতিমাসে সাড়ে ৪ হাজার প্লাস্টিক বর্জ্য চীনে রফতানি হচ্ছে। বিপিএফএমইএর তালিকাভুক্ত ৭০ রফতানিকারক বিদেশে পণ্য রফতানি করছেন। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ তালিকাবহির্ভূত রফতানিকারক পেট বোতলের কুচি রফতানি করছেন বলে জানা যায়। পেট ফ্লেকস্ বা বোতল কুচি বিদেশে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে উন্নতমানের কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। মেশিনে গলানোর পর প্লাস্টিক মন্ডকে পুনরায় নতুন প্লাস্টিক বোতল তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।
×