ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমা চেয়ে চমক শেখ হাসিনার

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

ক্ষমা চেয়ে চমক শেখ হাসিনার

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গিয়ে আমার বা আমার সহকর্মীদের ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। আমি নিজের এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি’Ñ দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও কোন দলীয় প্রধানের এভাবে মানুষের কাছে বিনয়াবনত হয়ে বলার নজির রাজনীতিতে নেই। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিনয়ী হয়ে দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সমৃদ্ধির পথ দেখিয়ে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপিকে রীতিমতো ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছেন। সুদূরপ্রসারী ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে ৮০ পৃষ্ঠার ইশতেহারের বিপরীতে জনসম্পৃক্তহীন কিছু বিষয়ে ৯ পৃষ্ঠার ইশতেহার দিতে গিয়ে পেছনের সারিতে পড়ে গেছে বিএনপি। এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে এড়িয়ে যাওয়া, জনসম্পৃক্তহীন কিছু রাজনৈতিক নিয়ে কথা বলা আর চাকরির বয়স তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে লাভের পরিবর্তে ক্ষতির মুখেই পড়েছে বিএনপি। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে ‘তরুণদের সঙ্গে প্রহসন’ অভিহিত করে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। সরকারের বিরুদ্ধে দেশের তরুণ সমাজকে জাগিয়ে তোলার আশায় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেয়ার ঘোষণা দিলেও ফল হয়েছে উল্টো। ইতোমধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবাদ শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝর। তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের এ ধরনের ঘোষণা দেশের তরুণ শিক্ষিত সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে। যেখানে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক চাকরি পাচ্ছেন না সেখানে সকল বয়সের মানুষের চাকরির সুযোগ দেয়ার চিন্তা দেশের জন্য অশনিসংকেত। আরেকবার ক্ষমতা পেলে বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধি এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের ৮০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ইশতেহারে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই প্রতিশ্রুতির দলিলে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে আগামী পাঁচ বছরে জিডিপি অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ১০ শতাংশ। ২০২১ সালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। একই সঙ্গে তিনি অঙ্গীকার করেছেন, ভবিষ্যতে তার সরকারের উন্নয়নের লক্ষ্য হবে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, অর্থাৎ যার সুফল সবাই পাবে, আয়ের বৈষম্য কমবে, মানুষের কাজের ব্যবস্থা হবে। এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই বলছে তাদের ইশতেহারে তরুণদের দিকে বাড়তি মনোযোগ আছে। নির্বাচনে একদম নতুন ভোটার আছে দুই কোটির উপরে। একটা বিপুলসংখ্যক ভোটার এবার জীবনে প্রথম ভোট দেবেন। পরপর দুইবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা অন্য কোন সরকারের শাসনকাল অনেক দিন ধরে দেখেননি। বলা হচ্ছে এবার তাই তরুণ ভোটাররা হয়ত নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। তরুণদের সাম্প্রতিক দুটি আন্দোলন ইশতেহারে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে। তরুণদের জন্য আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ বলছে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে, বিশেষ করে তরুণদের মেধা, সৃজনশীল ক্ষমতা কাজে লাগানোর জন্য অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উপরে বিশেষ জোর দেয়া হবে। ইশতেহারে তরুণদের জন্য যে অংশটি রয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগ আবারও ‘ডিজিটাল’ শব্দটি গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেছে। যে শব্দটি গত দুই বারের সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রচারে ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। যার সুফলও পাচ্ছে দেশ। ইশতেহার বলছে, ‘সোনার বাংলা’ স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানতম শক্তি হচ্ছে যুব শক্তি’। তাদের জন্য করা আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার কয়েকটি হলোÑ সরকারী চাকরিতে শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা ছাড়া আর কোন কোটা থাকবে না। তরুণদের আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে বিনা জামানতে ও সহজ শর্তে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা আরও বিস্তৃত করা হবে। আগামী তিন বছরের মধ্যে সরকারী শূন্য পদে নিয়োগ সম্পন্ন করা। ব্যাপক সংখ্যক ননÑ গ্রাজুয়েটের কর্মসংস্থান হবে কৃষি উৎপাদন এবং বিপন্ন সমবায়ে। আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি ২৮ লাখ কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা। ত্রিশোর্ধ শিক্ষিত বেকারের জন্য বেকার ভাতা চালু করার উদ্দেশে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা পরীক্ষা করে তা বাস্তবায়ন করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচী দেশের প্রতিটি জেলায় প্রসারিত করা হবে। প্রতটি উপজেলায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। আছে সুদূরপ্রসারী ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০। মেগা প্রজেক্টগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর ‘বিশেষ ব্যবস্থা’, আছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা। সোমবার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্ট বলেছে, সরকারী চাকরিতে যোগ দেয়ার বয়সসীমা তুলে দেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম চলমান রাখবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের তালিকা করবে। ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। এমন ৩৫ দফা অঙ্গীকারের ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে একই প্রতীকে নির্বাচন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে আছে এ জোট। ক্ষমতায় গেলে ‘রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করাসহ ১৯টি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে বিএনপি। মঙ্গলবার ইশতেহারে এসব প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আলমগীর বলেন, নির্বাচনের জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে ঐকমত্য, সবার অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিহিংসাহীনতা এই মূলনীতির ভিত্তিতে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধান, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন, সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পীকার নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিসিয়াল সিক্রেট এ্যাক্ট বাতিল, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, বেকার ভাতা প্রদানসহ ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঐক্যফ্রন্টে আছে, কিন্তু বিএনপিতে নেই। ইশতেহার ঘোষণার সময় বিএনপি মহাসচিবকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করা হলে উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুধু বলেছেন, পরে ওয়েবসাইটে ইশতেহারের বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। জানা গেছে, জামায়াতের কথা বিবেচনা করেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কোন কথা বলেনি। ইশতেহারের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সির ঢাকা অফিসের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের প্রশংসা করেছেন। বলেন, এ ধরনের ভুল স্বীকার আমাদের সংস্কৃতিতে বিরল। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও এই বক্তব্যে তার ভেতর আত্মবিশ্বাসের একটি ঘাটতি চোখে পড়ে। এটি একটি ইতিবাচক বিষয়। এর একটি প্রতীকী গুরুত্ব আছে। বিএনপির ইশতেহারকে জনসম্পৃক্তহীন রাজনৈতিক ও প্রতিষ্ঠানটির কিছু মতামত বলে অভিহিত করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ভূইয়া। তিনি বলছিলেন, আওয়ামী লীগের সুদূরপ্রসারী ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে ৮০ পৃষ্ঠার ইশতেহারের বিপরীতে জনসম্পৃক্তহীন কিছু বিষয়ে ৯ পৃষ্ঠার ইশতেহার দিতে পেরেছে বিএনপি। তারপরও যা বলেছে তা অবাস্তব কিছু বিষয় মনে হয়েছে আমার কাছে। যেখানে জনমানুষের প্রয়োজনের কিছু নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিষয় এগিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে ফ্রন্টের সঙ্গে এ বিষয়ে মতভেদ আছে। অর্থাৎ বিএনপি ফ্রন্টের মতের বিপরীতে আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাকরির বয়স তুলে দেয়া এটা পশ্চিমা দেশে সম্ভব, আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ বেকার শিক্ষিত যুবকের দেশে এটা অগ্রহণযোগ্য। বরং এটা যুব সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। আসলে তারা এটা করলে ক্ষতি হবে দেশের তরুণ শিক্ষিত সমাজের। এটা মানা যায় না। অগ্রহণযোগ্য। এদিকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে ‘তরুণদের সঙ্গে প্রহসন’ অভিহিত করে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। ঘটনা নিয়ে রীতিমতো গ্যাড়াকলে পড়েছে তারা। বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে ইতোমধ্যেই ‘তরুণদের সঙ্গে প্রহসন’ বলেছে আওয়ামী লীগ। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝর। তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের এ ধরনের ঘোষণা দেশের তরুণ শিক্ষিত সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে। যেখানে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক চাকরি পাচ্ছে না সেখানে সকল বয়সের মানুষের চাকরির সুযোগ দেয়ার চিন্তা দেশের জন্য অশনিসংকেত। আসন্ন ৪০তম বিসিএসের চাকরি প্রার্থী হাবিব বলছিলেন, চাকরির বয়স তুলে দেয়া হবেÑ এটা আপাতভাবে শুনতে ভাল লাগলেও একটু যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে কি হবে আসলে? মনে করুন, ছেলের বয়স ২৫, আর বাবার ৫০ বছর। ছেলে সবেমাত্র পাস করে বেরিয়েছে আর বাবা অনেক আগে পাস করে ২০ বছর ধরে বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োজিত। এখন নতুন নিয়মে যদি দুইজনই সরকারি চাকরিতে আবেদন করে, তাহলে চাকরিদাতা কি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বাবাকে নেবে, নাকি সদ্য পাস করা তরুণকে নেবে? অন্তত বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে চাকরির বয়সসীমা তুলে দেয়া তরুণদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাদ লিখেছেন, দেশে চাকরির বয়সসীমা তুলে দিলে তরুণদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। সস্তা বুলি, তরুণদের বোকা বানাবার জন্য। বাস্তবতা বিবর্জিত, একটাও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সক্ষমতা যাচাই ছাড়া হাওয়াই প্রতিশ্রুতি কোন সৎ রাজনীতিবিদ দিতে পারেন না। চাকরির বয়সসীমা শুরুরটা না থাকলেও শেষটা তো থাকবে! সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোন বয়স থাকবে না। আমি আর আমার নাতি একসঙ্গে সরকারী চাকরির আবেদন করতে পারব !!! নাসরীন আক্তার নামে একজন তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, সরকারী চাকরিতে তাহলে বুড়াদের সমাবেশ ঘটবে। তরুণদের বিপদ আসছে। তরুণেরা কি ঘরে বসে থাকবে? কর্মসংস্থানের ব্যাপারে কোন প্রতিশ্রুতি নেই। চাকরির বয়স উঠিয়ে কিছুই হবে না। সরকারী চাকরিতে তাহলে বুড়াদের সমাবেশ ঘটবে।
×