ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুবাই থেকে মদদ দিচ্ছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে আইএসআই

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে আইএসআই

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে বিশ দলীয় জোটের যে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে পর্দার অন্তরাল থেকে তার মদদ দিয়েছে ওই গোয়েন্দা সংস্থাটিই। গোয়েন্দা সংস্থাটির পরামর্শে লন্ডনে বসে এটা করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান। পাকিস্তান চায়, ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জামায়াতে ইসলামকে। দুবাই থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাটি। তদন্তে-অনুসন্ধানে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে আইএসআইয়ের এক কর্মকর্তার কথোপকথনের অডিও ফাঁসের সূত্র ধরে তদন্ত ও অনুসন্ধান শুরু করে ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিজেদের মনোভাবাপন্ন ও সমর্থক দল বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতকে ক্ষমতায় আনতে চেষ্টা চালাচ্ছে আইএসআই। দুবাই থেকে কলকাঠি নেড়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের পাঁয়তারা করছে তারা। আইএসআই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই যে প্রভাব বিস্তারের অপতৎপরতা চালাচ্ছে, তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তা আবারও ফাঁস করেছে ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাসহ সেভেন সিস্টারের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের মাটি ব্যাবহার করতে পারে। চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদের যেই ধরনের চোরাচালান আটক করা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় সেই ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদের চোরাচালান আসার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এ জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করে লন্ডনে বসবাসকারী সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির নেতাদের নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এমনকি লন্ডনে বসবাসরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে পাকিস্তানী এই গোয়েন্দা সংস্থাটি। পাকিস্তানের এই গোয়েন্দা সংস্থাটিকে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছে বিএনপি-জামায়াত নেতারা। বিএনপি-জামায়াতের নেতারা মতামত দিয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে হলে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি টেলিফোনে মেহমুদ নামে যে ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন, তার পুরো নাম শহীদ মেহমুদ মুহাম্মদ শরিফ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৪তম লং কোর্সে তিনি কমিশন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি আইএসআইয়ে যুক্ত হন। ২০০৪ সালে অবসরে যাওয়ার পর থেকে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বসবাস করছেন। বর্তমানে আইএসআইয়ের বেতনভুক্ত এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন তিনি। বাংলাদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আইএসআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন মেহমুদ। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া কিছু নথিপত্র দুবাইয়ে বিএনপির সংযুক্ত আরব আমিরাত শাখার সভাপতি জাকির হোসেনের। জাকির হোসেনের মাধ্যমেই যোগাযোগ রাখেন লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান। ড. খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অডিও কথোপকথন গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে পরীক্ষা করা হয়। এতে শোনা যায়, বিএনপির এই নেতা বাংলাদেশে তাদের দলের কর্মকা-ের জন্য আইএসআইয়ের সরাসরি সহায়তা চাইছেন। তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এখন ভীষণ সমস্যার মধ্যে আছি। এই বিপদ থেকে আপনারাই উদ্ধার করতে পারেন।’ ওই কথোপকথনে আগামী নির্বাচনে চীনকে ‘ম্যানেজ’ করার জন্য মেহমুদকে অনুরোধ করেন খন্দকার মোশাররফ। এর জবাবে মেহমুদ আইএসআইয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার এবং এ ব্যাপারে কাজ করার আশ্বাস দেন। খন্দকার মোশাররফ ঢাকায় আইএসআইয়ের কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্টের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মেহমুদ জানান, তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এজেন্ট বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। তবে ওই অডিও কথোপকথনের কথা অস্বীকার করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমি এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছি। বিষয়টি মিথ্যা, বানোয়াট ও ভুয়া। ওই (শহীদ মেহমুদ) নামে আমি কাউকে চিনিও না। আমি কারও সঙ্গে কথাও বলিনি।’ বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আইএসআই প্রভাব বিস্তারের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আমার সঙ্গে কারও কথা হয়নি। আমার এ বিষয়টি জানা নেই। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেহমুদ ২০০৪ সালে আইএসআই থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকে সংস্থাটির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। দুবাইতে তিনি আল মারজান আল কাবের জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। আইএসআইয়ের কাছ থেকে তিনি মাসে তিন হাজার ডলার বেতন পান। বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি তার বেতন বাড়িয়ে চার হাজার ডলার করা হয়েছে। আইএসআইয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা জাভেদ মেহেদীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন শহীদ মেহমুদ। তার কাজই হলো জাভেদ মেহেদীর সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করা। মেহমুদ সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির সভাপতি জাকির হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। জাকির হোসেন সিলেটের জকিগঞ্জে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ের রয়েল প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজে কর্মরত। এবারের নির্বাচনে জাকির হোসেন জকিগঞ্জ থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেতে আগ্রহী ছিলেন। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসে জাকির হোসেন অন্তত ১১ বার শহীদ মেহমুদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বশেষ যোগাযোগ হয় গত ৭ ডিসেম্বর। অনুসন্ধানে পাওয়া গোয়েন্দা নথিপত্রে দেখা গেছে, জাকির হোসেন বিএনপি ও জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আইএসআইয়ের গোপন যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগেরও মাধ্যম তিনি। মেহমুদের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি তারেক রহমানকে ‘বস’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। জাকির হোসেন ও শহীদ মেহমুদের একাধিক কথোপকথন থেকে জানা যায়, সৌদি আরবে তারেক রহমানের সঙ্গে আইএসআইয়ের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা জাভেদ মেহেদীর একটি বৈঠক হয়েছে গত ৪ জুলাই। খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে আইএসআই এজেন্ট মেহমুদের ফোনালাপ এবং জাকির হোসেনের সঙ্গে মেহমুদের ১১টি বৈঠক সংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে গোয়েন্দারা দেখতে পান, ঢাকা এবং দেশের বাইরে কয়েকটি শহরে পাকিস্তানী এই গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক এজেন্টের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে নানামুখী তৎপরতা চালাতে আইএসআই সক্রিয় রয়েছে। এমনকি আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেয়ার জন্য আইএসআইয়ের পক্ষ থেকে একটি তালিকাও বিএনপির কাছে দেয়া হয়েছে। তালিকাটি তারেক রহমানের কাছে পৌঁছানোর পর সেই অনুযায়ী ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন নিশ্চিত করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত নেতৃবৃন্দ বরাবরই তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর যোগাযোগ থাকার বিষয়টি অস্বীকার করলেও অডিও ফোনালাপ, প্রয়োজনীয় নথিপত্র, অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে দেশের ভেতরে ও বাইরে যারা যোগাযোগ রক্ষা করছে তাদের মধ্যে আছেন বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এর আগে আমেরিকায় থেকে সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা সাদেক হোসেনের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার অডিওতে শোনা গেছে, লাশ ফেলার ফোনালাপ। আইএসআই সব সময় বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর নগ্নভাবে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালায়- এটা ওপেন সিক্রেট। বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতাকর্মীই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর শীর্ষ কর্মকর্তা বলে পরিচিত এজেন্টের সঙ্গে ফোনালাপের অডিও ফাঁস হয়েছে সে বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মামলাটি এখন তদন্তনাধীন।
×