ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

একটি রাজনৈতিক প্রহসনের কিছু খণ্ডাংশ

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

একটি রাজনৈতিক প্রহসনের কিছু খণ্ডাংশ

আমার অবস্থা এখন ‘আরব্য রজনীর’ বাদশাহের বেগমের মতো। বাদশাহ রোজ একটি করে বিয়ে করতেন। বিয়ের শর্ত ছিল নববিবাহিতাকে এমন গল্প শোনাতে হবে যার কোন শেষ নেই। নইলে গর্দান যাবে। এই গর্দান রক্ষার জন্য বাদশাহকে যত গল্প শোনানো হয়েছিল তারই সমাহার আরব্য রজনী। এটা তো সেই প্রাচীন যুগের কাহিনী। এ যুগে আমার ওপর ঢাকার সম্পাদকদের (যেসব কাগজে লিখি) হুকুম, আসন্ন সাধারণ নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোন বিষয়ে নয়, কেবল দেশের রাজনীতি নিয়ে লিখতে হবে। আমি ছাপোষা সাংবাদিক, সম্পাদক প্রভুদের এই হুকুম জারি হওয়ার পর এখন পর্যন্ত যে গর্দান রক্ষা করতে পেরেছি, সেজন্যে নিজেকেই নিজে অভিনন্দন জানাই। আর অভিনন্দন জানাই ড. কামাল হোসেনকে। এই বৃদ্ধ বয়সে কার্যত রাজনৈতিক অবসর জীবন থেকে সহসা বেরিয়ে এসে তিনি যেসব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন তাতে লেখার বিষয়ের অভাব হচ্ছে না। গর্দানটা রক্ষা করতে পারছি। নইলে আরব্য রজনীর বাদশাহের কোন কোন বেগমের মতো কবেই আমার গর্দান যেত। ব্রিটেনের এক বিখ্যাত কলামিস্ট ছিলেন বামপন্থী। কিন্তু সকল মতামতের পাঠকের কাছে জনপ্রিয়। চার্চিলের সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির তিনি এতটাই বিরোধী ছিলেন যে, তিনি একটানা দশ বছর চার্চিলের বিরুদ্ধে লিখেছেন। চার্চিল মারা যাওয়ার পর তিনি তার দীর্ঘ অবিচুয়ারি লিখেছেন। আর এই অবিচুয়ারি লেখার কারণ তার পাঠকদের জানাতে অবিচুয়ারির শুরুতেই লিখেছেন, ‘আমি স্যার উইনস্টন চার্চিলের যতই সমালোচনা করে থাকি, একটা কারণে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। দীর্ঘ দশ বছর তিনি আমার ব্রেড এ্যান্ড বাটারের ব্যবস্থা করেছেন। এই দশ বছর আমার কলাম লেখার জন্য আমাকে বিষয় খুঁজতে হয়নি। এই বিতর্কিত চরিত্রের মানুষটি রোজই এত বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন যে, তা নিয়ে লিখলে পাঠকরা গোগ্রাসে গিলতেন। সম্পাদকরাও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ছাপতেন।’ ইদানীং এই অবস্থা ঘটেছে আমার কলামিস্ট জীবনেও। দীর্ঘকাল ড. কামাল হোসেন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। থাকলেও নেপথ্যের কারিগর ছিলেন। নেপথ্যের খেলাতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। তার প্রমাণ তিনি ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় দিয়েছেন। এবার ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে সহসা কেন একেবারে প্রকাশ্যে মেকআপ খুলে রঙ্গমঞ্চে বেরিয়ে এলেন, তা অনেকের কাছেই এক বিরাট রহস্য। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব হারিয়ে (একজন জেলে, আরেকজন বিদেশে পলাতক) আগামী নির্বাচনে নেতৃত্বহীন অবস্থায় লড়তে সাহস না পেয়ে ড. কামাল হোসেনকে নেতা হিসেবে ‘হায়ার’ করেছেন। তাতে বিএনপির কতটা লাভ হয়েছে বা হবে, তা জানি না। কিন্তু চার্চিলের সমালোচক ব্রিটিশ কলামিস্টের মতো আমার লাভ হয়েছে। বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি নিয়ে লিখি, তাতে মাঝে মাঝে লেখার সাবজেক্ট খুঁজতে মাথার চুল ছিঁড়তে হতো। ড. কামাল নিজগুণে আমার এই সমস্যাটির সমাধান করে দিয়েছেন। গত দেড়/দু’মাস আমাকে লেখার সাবজেক্ট নিয়ে ভাবতে হয়নি। ঐক্যফ্রন্টের নেতা হওয়ার জন্য এবং হওয়ার পরে নিজের অতীতকে অস্বীকার করে তার কথাবার্তা এবং বিএনপির বাঁশির সুরে সুর মিলিয়ে তার বৃদ্ধ বয়সের নৃত্য আমাকে অনবরত লেখার খোরাক জুগিয়েছে এবং এখনও জোগাচ্ছে। আিম এজন্য ড. কামালের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমার গত দু’মাসের ব্রেড এ্যান্ড বাটারের ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছেন। সম্ভবত নির্বাচনের দিন পর্র্যন্ত এই ব্যবস্থাটা আমার থাকবে। সংস্কৃতিমন্ত্রী (এখন এই সরকারের বিদায়ী মন্ত্রী) আসাদুজ্জামান নূর আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তিনি এতই বিনয়ী যে, তাকে একবার একটা অনুরোধ জানাতেই বিনয়ে গদগদ হয়ে বলেছিলেন, ‘গাফ্ফার ভাই, আমি তো একজন পারফর্মার, নাট্যকার নই।’ আমার বন্ধু ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকের নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকও এখন বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে অনুরোধ জানাতাম, দোস্ত, একটা রাজনৈতিক স্যাটায়ারমূলক নাটক লিখে দাও, আমাদের রাজনীতির একজন জীবিত পুরুষ নিয়ে। যদি শচীন সেনগুপ্তও আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে দ্বিতীয় কাশিমবাজার কুঠির চক্রান্ত নিয়ে একটি দর্শকপ্রিয় নাটক লিখতেন। আমি নাট্যকার নই। টেনেটুনে যা লিখি, তা না হয় স্যাটায়ার, না হয় নাটক। তাই ‘ঢাকার ড. জেকিল ও হাইড’ নামে একটি নাটক লেখার দারুণ ইচ্ছা মনে নিয়েও কলম ধরার সাহস হচ্ছে না। অথচ এই নাটকের প্রথম দৃশ্যের একটা চমৎকার ছক আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। একটু নমুনা দিচ্ছি। সময় সন্ধ্যা : স্থান, একজন বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ-কাম রাজনীতিকের বাসা। যবনিকা উঠলে দেখা যাবে, একজন রাজনীতিক-কাম আইনজীবী পা টিপে টিপে বাসায় ঢুকছেন। চিকিৎসক তাকে স্বাগত জানালেন। চিকিৎসক : কি অমন পা টিপে টিপে আসছেন কেন? আমাদের বন্ধুত্ব তো এখন সকলের জানা। আইনজীবী: বন্ধুত্বের কথা সকলের জানা। কিন্তু আমরা কি করতে যাচ্ছি, সেকথা কেউ জানে না। চিকিৎসক : শীঘ্রই সবাই জানবে। আমাদের উদ্দেশ্য হাসিনা এবং খালেদা দু’নেত্রীকেই রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়া। যে থিয়োরির নাম মাইনাস টু থিয়োরি। যে থিয়োরির স্রষ্টা আপনি এবং আপনার বন্ধু একজন নোবেল জয়ী। আইনজীবী: সে চেষ্টা তো করেছি। তা ব্যর্থ হয়েছে। আপনাকে এবং ব্রিজ সিদ্দিকীকে নিয়ে তো আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম, কিন্তু পারলাম না। বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়েও কিছু করতে পারেনি। দুর্নাম কুড়িয়েছে। এবার তাই লাস্ট এটেম্পট, বা ফাইনাল এটেম্পটও বলতে পারেন। নোবেল জয়ী ওয়াশিংটনে বসে গ্রীন সিগনাল দিয়েছেন। চিকিৎসক: এটাকে তাহলে আমাদের ফাইনাল কনেস্পিরেছি বলতে পারি। ফাইনাল ভিক্টোরি নিশ্চিত তো? আইনজীবী: আপনি বাঁকা চোখে ব্যাপারটা দেখছেন, এটা তা নয়। এবার মাইনাস ওয়ান থিয়োরি। প্রথমে হাসিনাকে হটাতে হবে। সেজন্যে খালেদার সাহায্য দরকার হবে। বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধতে হবে। উদ্দেশ্য থাকবে দুটি-হয় নির্বাচন বানচাল করা, নয় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসা। চিকিৎসক: তাহলে তো বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যাবে। আমাদের শুধু দুর্নাম হবে। বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামায়াতের সঙ্গেও হাত মেলানোর দুর্নাম সহ্য করতে পারবেন তো? আইনজীবী: ‘দিনের আলো’ আর ‘রাতের নক্ষত্র’ পত্রিকার দুই সম্পাদক আশ্বাস দিয়েছেন, তারা সূক্ষ্ম প্রচারের জোরে দিনকে রাত করে দেবেন। তাছাড়া দুই বকেয়া বিপ্লবী, সম্ভবত ব্রিজ সিদ্দিকীও থাকবে আমাদের সঙ্গে। এই ব্যাপারেও ওয়াশিংটন থেকে হাফ্ নোবেল লরিয়েট সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন। হাসিনার এবার আর রক্ষা নেই। চিকিৎসক : সবই বুঝলাম। আমি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছি। আপনি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করবেন। কথা হলো, তারেক রহমান আমাদের নেতৃত্ব মেনে নেবেন কি? আইনজীবী : মেনে না নিয়ে উপায়টা কি? আরে ওদেরই তো ঐক্যফ্রন্টে আসার গরজ বেশি। নইলে খালেদা-তারেক কেউ বাঁচবেন না। ওরা তো আমার নেতৃত্ব আগেই মেনে নিয়েছে। চিকিৎসক: কিন্তু তারেক আমার নেতৃত্ব কি মানবে? বিএনপিতে থাকাকালে সে কিভাবে আমাকে বেইজ্জত করেছে তা তো আপনি জানেন। আইনজীবী : আরে রেখে দিন তারেক-ফারেকের কথা। পশ্চিমা দেশগুলো জানে ওকে একটা সন্ত্রাসী ও ডাকাত হিসেবে। তাই তো পশ্চিমা দেশে আমাদের বন্ধুরা চায় তাকে কৌশলে বিএনপির নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে আমাকে বসাতে। তাহলে দলটি একটু ভদ্রস্থ হয়। ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। চিকিৎসক: তবু বলছি, তারেক সম্পর্কে সাবধান থাকবেন। দুর্বৃত্ত হিসেবে সে এক নম্বর। আপনাকে নিয়ে সে খেলতে পারে। আইনজীবী: তারেক খেলবে আমাকে নিয়ে? না, আমি ওকে নিয়ে খেলব? হাঃ হাঃ হাঃ। ॥ দুই ॥ প্রিয় পাঠক, এটুকু হচ্ছে আমার পরিকল্পিত নাটকের প্রথম দৃশ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা। দ্বিতীয় দৃশ্য নিয়েও চিন্তাভাবনা করেছি। তার অংশবিশেষ নিচে দিলাম। ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা। মির্জা সাহেব টেলিফোন ধরে বসে আছেন। টেলিফোনের রিসিভারের স্পীকার খোলা। কথা শোনা যাচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ কথা বলছেন। টেলিফোন : খেলাটা খুব সাবধানে খেলবেন। এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান আইনজীবী নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন। এটাই তার শেষ খেলা, সাপ আর বেজির খেলা। মির্জা: লিডার, ঐক্যফ্রন্টের নাম করে ওকে আমাদের জোটে টেনে খুব ভাল হয়েছে। আপনার খুব বুদ্ধি! টেলিফোন: বুদ্ধিটা দেখলেন তো। শেখ মুজিবের শিষ্য এখন তার হত্যাকারীর দলে এসে নৌকার বদলে ধানশীষ বুকে ধারণ করেছেন। কী দৃশ্য! হাঃ হাঃ হাঃ। মির্জা: জামায়াতীদের সঙ্গে রেখে আমাদের যে দুর্র্নামটা খুবই খারাপ অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, এই আইনজীবীর কল্যাণে তা চাপা পড়ে গেছে। নিজে নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পদটা আপনার জন্য একেবারে পাকা হয়ে আছে। টেলিফোন: কিন্তু ওই ডাক্তার ব্যাটা। ও তো আবার আইনজীবীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাকে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে রাখা দলে খেলাতে আমরা সুবিধা করতে পারব না। ও আমার শত্রু। ওকে কি করে ঠেকাবেন? মির্জা: লিডার, সে বুদ্ধিও বের করে রেখেছি। ওই আওয়ামী পরিবারের এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এখন ঘোর শত্রু এক ব্যারিস্টারকে কাজে লাগিয়েছি। তিনি আমাদের আইনজীবীরও বন্ধু! কাঁটা দিয়ে কাঁটা খুলতে হয়। ওই ব্যারিস্টারকে দিয়েই চিকিৎসককে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেব। টেলিফোন : খুব সাবধানে খেলবেন। আমার পরামর্শ ছাড়া এক পা নড়বেন না। মির্জা: এক পা নড়ব না। আজ রাতের মধ্যেই কী ঘটে যায় দেখুন। ॥ তিন ॥ প্রিয় পাঠক, দ্বিতীয় দৃশ্যের সবটা শেষ করতে পারিনি। এটা নাট্যকার হিসেবে আমার অক্ষমতা। তার তৃতীয় দৃশ্যের খানিকটা এবং শেষ দৃশ্যের অংশবিশেষ আপনাদের জানিয়ে রাখছি। নতুন ঢাকার, অবশ্য এখন পুরনো ঢাকার চাইতেও খারাপ অবস্থার রাস্তায় একটি অভিজাত বাড়ির সামনে একটি গাড়ি দাঁড় করানো। ভেতরে চিকিৎসক ও তার পুত্র বসে উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছেন। চিকিৎসক : আমাদের দাওয়াত দিয়ে এনে আইনজীবীর এ কি ব্যবহার! ঘণ্টার ওপর বসে আছি। তার বাসায় কেউ নেই। কেউ দরোজা খুলে দেয়ার জন্যও নেই। এ তো রীতিমতো অপমান! পুত্র : বাবা, আমি ওদের টেলিফোন করেছি। ওরা ব্যারিস্টার চাচার বাসায় বৈঠক করছে। ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক। চিকিৎসক : কী আমারে ছাড়া বৈঠক? আমার সঙ্গে আলোচনার জন্যই তো এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল! তাহলে কি আমাকে সরাবার চক্রান্ত চলছে? পুত্র : বাবা, তাই তো মনে হচ্ছে! সম্ভবত আইনজীবী চাচা একাই ঐক্যফ্রন্টের নেতা হতে চান! চিকিৎসক : (চিৎকার করে) মীরজাফর, মীরজাফর, নব্য বাঙলার মীরজাফর! ॥ চার ॥ সুধী পাঠক, নিজের অক্ষমতার জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সমগ্র নাটকটি আপনাদের উপহার দিতে পারলাম না বলে। তবে শীঘ্রই দিতে পারব আশা করছি। দশ/বারো দৃশ্যের নাটক। আমার অপটু হাতে শেষ করতে একটু সময় লাগবে। তবে শেষ দৃশ্য সম্পর্কে মনে মনে যা ভেবেছি তার খানিকটাও আপনাদের জানিয়ে দিয়ে অপরাধ কিছুটা লঘু করতে চাই। অবশ্য এই দৃশ্যটা ঘটার আগেই লিখছি। ২০১৯ সালের পয়লা জানুয়ারি। ইংরেজী নববর্ষের প্রথম দিন। স্থান : ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ। সকাল। একটা সোফায় বসে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী বার বার হাতঘড়ি দেখছেন। সামনে দিয়ে এয়ারপোর্টের এক স্টাফ যাচ্ছিলেন। আইনজীবী : হ্যাল্লো মিস্টার। স্টাফ : ইয়েস স্যার। আইনজীবী : আমি লন্ডন ফ্লাইটের যাত্রী। টাইম তো পেরিয়ে যাচ্ছে। ক’টায় প্লেন ছাড়বে? স্টাফ : মেকানিক্যাল প্রব্লেম, ফ্লাইট ডিলেড দু’ঘণ্টার জন্য। আইনজীবী : সর্বনাশ। (হুড়মুড় করে দু’তিনজন লোক ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন।) প্রথম ব্যক্তি : আমরা যা ধারণা করেছিলাম, আপনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আমাদের না জানিয়েই যাবেন? আপনি কি করে জানলেন আমরা নির্বাচনে পরাজিত হচ্ছি? ভোট হলো, মাত্র গতকাল স্যার। আইনজীবী : আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। হঠাৎ একটা কেসের ব্যাপারে দু’দিনের জন্য লন্ডনে যাচ্ছি। তাই আপনাদের জানাইনি। আর নির্বাচনের সঙ্গে তো আমার লন্ডনে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয় ব্যক্তি : আছে স্যার আছে। আপনি দেশে নেই জানাজানি হতেই সাধারণ মানুষ বলবে নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট পরাজিত হতে যাচ্ছে জেনে আপনি দেশ ছাড়ছেন। পাসপোর্ট ভিসা, প্লেনের টিকেট আগেই ঠিক করা ছিল। তৃতীয় ব্যক্তি : আমাদের পথে ভাসাবেন না স্যার। আপনাকে দেখে ঐক্যফ্রন্টে এসেছি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কত বড় বড় কথা বলেছি। ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার আর জামায়াতের সঙ্গে এসে হাত মিলিয়েছি। সবই করেছি আপনাকে অনুসরণ করে। এখন দেশের লোক ছিঃ ছিঃ করবে, আমাদের দেখে হাসবে। আপনাকে নেতা বলে মেনেছিলাম। আমাদের এতিম করে পালিয়ে যাবেন না স্যার। আইনজীবী : আমি কি পালাই? প্রথম ব্যক্তি : সে কথা আর বলতে চাই না স্যার। নিজেরাই লজ্জা পাব। আইনজীবী : আমরা নির্বাচনে হেরেছি বলে কি নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে যে, আমি পালিয়ে যাব? দ্বিতীয় ব্যক্তি : আকাশে কালো মেঘের সঞ্চার দেখলেই বোঝা যায় বৃষ্টি হবে কি হবে না! গতকাল সন্ধ্যার দিক থেকেই বোঝা গেছে স্যার হাওয়া কোন্্দিকে? হাওয়া নৌকার দিকে। ধানের শীষের দিকে নয়। ওই শুনুন, বাইরে রাস্তায় কী স্লোগান হচ্ছে! (বাইরে জনতার স্লোগান-জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ হাসিনা)। আইনজীবী : (ত্রস্তে উঠে দাঁড়িয়ে) আমি যাই। দু’দিনের জন্য যাচ্ছি। এসেই আপনাদের সঙ্গে বৈঠকে বসব। আমি আসি! (বিমানের স্টাফটি ছুটে এলো।) স্টাফ : কই যাচ্ছেন স্যার, ফ্লাইট ডিলেড। প্লেনে ওঠার এনাউন্সমেন্ট এখনও হয়নি। আইনজীবী : (রাগতভাবে) গোল্লায় যাক বিমান। প্রথম ব্যক্তি : আমরা বলছিলাম কি স্যার, চলুন, আপনাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাই। আইনজীবী : (আরো রেগে গিয়ে) বাসায় ফিরে গিয়ে কি করব? তৃতীয় ব্যক্তি : কেন স্যার, নির্বাচনে আমরা হেরে গেছি ঘোষিত হওয়ার পর আমাদের জয় আওয়ামী লীগ ছিনতাই করেছে বলে একটা ঘোষণা দিতে হবে না? (যবনিকা পতন)। [লন্ডন, ১৮ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৮
×