ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত দিবস আজ

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত দিবস আজ

সংবাদদাতা, সৈয়দপুর, নীলফামারী, ১৭ ডিসেম্বর ॥ পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালীর কাছে মিনি পাকিস্তান হিসেবে খ্যাত স্বাধীন বাংলাদেশের জনপদ সৈয়দপুর ১৯৭১ সালের আজকের দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। ভারতের হিমকুমারী ক্যাম্প থেকে মিত্র বাহিনীসহ মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয়রা প্রবেশ করলে পাকবাহিনী সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ১৮ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। এ জনপদে ভাষাগত পার্থক্যর প্রভাবে বাঙালীদের ওপর বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন বেড়ে যায়। জাতীর পিতার শোষণমুক্তির বার্তা ও পরে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ-ের ইঙ্গিত পেয়ে উদ্বেলিত বাঙালী অসহযোগ আন্দোলনে করে। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানী পতাকার বদলে কালো পতাকা উত্তোলন করলে অবাঙালীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে অবরুদ্ধ বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন মোশারফ হোসেন, মাহাতাব বেগ, মোহাম্মদ আলীসহ অনেকে। হত্যাকা- ও তা-বের নির্মমতায় গ্রাম জালিয়ে এ জনপদের বুদ্ধিজীবীদের আটক করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ১২ এপ্রিল রংপুরের নিসবতগঞ্জের বালারখালে এমপিএ ডাঃ জিকরুল হক, ডাঃ শামসুল হক, ডাঃ বদিউজ্জামান, ডাঃ আমিনুল হক, ডাঃ ইয়াকুব আলী ও তুলশীরাম আগরওয়ালা, ডাঃ ইয়াকুব আলীসহ অনেককে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। ১৩ জুন স্থানীয় মারোয়াড়িদের ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রেনে উঠিয়ে গোলাহাট নামক স্থানে ৪৪৭ জন মারোয়াড়ি নারী পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নারীদের গোলাহাট আস্তানা-ই-হক বিল্ডিংয়ে নিয়ে গিয়ে সম্ভ্রম হানী ঘটানো হয়। পরে স্বাধীনতার পর ওই নারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় আরও ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকসেনারা। কারখানার বয়লার শপে (উপ-কারখানা) জীবন্ত নিক্ষেপে ৩শ’ বাঙালীকে পুড়িয়ে মারা করা। শহরের প্রবেশ মুখগুলোকে বানানো হয় কিলিং স্পটের খরচা খাতা। এসব হত্যাকা- ঘটানো হতো ১নং খরচা খাতা (গোলাহাট বধ্যভূমি), ২নং খরচা খাতা (মুন্সিপাড়া বধ্যভূমি), ৩নং খরচা খাতা (ভাগার বধ্যভূমি) ও ৪নং খরচা খাতা (সৈয়দপুর স্টেডিয়ামের বধ্যভূমি)। সেখানে গভীর কূপে বাঙালীদের টুকরো দেহ নিক্ষেপ করত। হতো হত্যাকা-ের হিসাব। গোটা শহর জল্লাদ খানায় রূপান্তর করেছিল পাকসেনা ও তাদের দোসররা। তবে গোলাহাট ছাড়া অদ্যাবধি ওই সবস্থানগুলোকে চিহ্নিত করে বধ্যভূমি ঘোষণা করা হয়নি। পরে সারাদেশে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করায় পাকসেনারা পিছু হটে এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ১৮ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় মেনে নেয়। বিজয়ের খবরে গ্রাম থেকে হাজার মানুষ শহরে এসে আনন্দ মিছিল করে তৎকালীন পৌরসভার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়। তবে এতে প্রায় ৫ হাজার মানুষ শহীদ হয়। তৎকালীন সময়ে সৈয়দপুরে ৪০ হাজার বিহারির অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার যুদ্ধাপরাধী বলে স্বীকৃত বলে মনে করেন স্থানীয়রা। বগুড়া স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া অফিস থেকে জানান, মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর চতুমুর্খী আক্রমণে বগুড়ায় হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পলায়ন ও আত্মসমর্পণের পালা শুরু হয় ডিসেম্বরের মধ্যভাগেই। দেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের দুই দিন পর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিকেলে বগুড়া সেনানিবাসে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর আগে তৎকালীন উত্তরাঞ্চলের প্রধান ১৬ ইনফ্রেন্টি ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল নাজার হুসেন শাহ পালিয়ে যান নাটোর সেনানিবাসে। বগুড়া সেনানিবাস মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর দখলের আসার পর মিত্র বাহিনীর ২০ মাউন্টেন রেজিমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল লাছমান সিং হানাদার পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করেন। তিনি পালিয়ে থাকা পাক সেনাবহিনীর জেনারেল নাজার হুসেন শাহকে বন্দী করে বগুড়া আনার জন্য ব্রিগেডিয়ার রাঘুবর সিং পান্নুকে নাটোর পাঠান। ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে পাকিস্তানী জেনারেলকে বগুড়া আনা হয়। বিকেলের আনুষ্ঠানিকতা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিওসি মেজর জেনারেল নাজার হুসেন শাহ উত্তরাঞ্চলের দখলদার হানাদার পাকিস্তান সেনাবহিনীর পক্ষে নিজের পিস্তলটি গুলিশূন্য করে মিত্র বাহনীর জেনারেল লাছমন সিংয়ের হাতে তুলে দেন। উত্তরাঞ্চলের হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর ট্যাংক, কামান, ভারি মাঝারি ও ছোট সব আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৩শ’ ৪ অফিসার, ৩শ’ ৭১ জেসিও, ১১ হাজার ২শ’ ১৮ জন অন্যান্য পদবির সৈনিক, ৩ হাজার আধাসামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ওইদিন আনুষ্ঠানকভাব মুক্ত হয় বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চল। নওগাঁ নিজস্ব সংবাদদাতা নওগাঁ থেকে জানান, দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও নওগাঁ হানাদার মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ২৬ মার্চেই নওগাঁয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রথম ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট বয়তুল্লাহকে (এনএনএ) আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। এ পরিষদে অন্যান্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য ছিলেন, মোঃ আব্দুল জলিল, মোঃ জালাল হোসেন চৌধুরী, আ ন ম মোজাহারুল হক (ন্যাপ ভাসানী), এমএ রকীব (ন্যাপ মোজাফফর), আকতার আহমেদ সিদ্দিকী, একেএম মোরশেদ প্রমুখ। নওগাঁ কেডি উচ্চ বিদ্যালয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় স্থাপিত হয়। এখানে বসেই সব ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হতো। নওগাঁ ছিল ইপিআর ৭ নং উইংয়ের হেড কোয়ার্টার। ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিবাহিনী রাজশাহী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চেই নওগাঁ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার শপথ গ্রহণ করে। ২৫ মার্চে ঢাকাসহ দেশের বহু এলাকা পাকি হানাদারদের আক্রমণের শিকার হলেও নওগাঁ মুক্ত ছিল প্রায় এক মাস।
×