ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বিজয়ের মাস ॥ ইতিহাসের প্রেক্ষিত

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বিজয়ের মাস ॥ ইতিহাসের প্রেক্ষিত

৪৭ বছরের পথপরিক্রমায় আমরা নতুন করে বিজয়ের মাহাত্ম্য স্মরণে এনে সমকালীন ঘটনাকে একীভূত করে আরও একটি মহৎ অর্জনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। উৎসব আর আয়োজনে মুখরিত এই মাসে সারাদেশ নির্বাচনকে সামনে রেখে মহিমান্বিত অধ্যায়টিকে অনেক বেশি করে উপলব্ধিতে আনবে এটাই তো স্বাভাবিক। বিজয়ের মাসটিতে শুধু যে স্বাধীনতার লাল সূর্য সারা বাংলাকে রাঙিয়ে দিয়েছিল তা কিন্তু নয়; তার চেয়েও বেশি ক্ষত-বিক্ষতের যন্ত্রণায় আপামর বাঙালী যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পতিত হয় সে করুণ আখ্যানও আমাদের শোকে আচ্ছন্ন করে দেয়। ১৬ ডিসেম্বরের মাত্র দু’দিন আগে। ১৪ ডিসেম্বর তৎকালীন পাক জঙ্গী বাহিনী আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতকে যে মাত্রায় লাঞ্ছিত আর রক্তাক্ত করে সে ইতিহাসও অনেক বেদনার। তারও আগে নয় মাসের রক্তাক্ত পথযাত্রা কোনভাবেই সুুখকর, নিরাপদ কিংবা নির্বিঘ্ন ছিল না। সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ’৪৭-এর দেশ বিভাগও ছিল এক অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত ব্যবচ্ছেদ। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো এই বিভক্তি কোনভাবেই সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সফল হয়নি। বীজ বপিত হয় সেই ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনামলে। প্রথিতযশা এবং পথিকৃৎ সাংবাদিকই শুধু নন ভাষাসৈনিকদের নিয়ে লেখা অমর সঙ্গীত রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একটি সারগর্ভ উক্তি আজও স্মরণ করতে ইচ্ছে করে। স্বাধীনতার পর ড. এ আর মল্লিকের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ প্রবন্ধ সঙ্কলন। সেখানে এই যশস্বী সাংবাদিকের একটি লেখা ‘দ্বিজাতিতত্ত্বে¡র অপঘাতে মৃত্যু’তে বলা হয়Ñ একদা ইউরোপের যে রাজন্যবর্গ ধর্মযুদ্ধের বর্ম এঁটে পাশ্চাত্যে যে বিভাজন প্রক্রিয়ায় আধিপত্যের সূত্রপাত করে তারাই শিল্প বিপ্লবের মহানায়কের ভূমিকায় নেমে তাদের উপনিবেশ অঞ্চলগুলোতে দ্বিধাবিভক্তির ধারাও তৈরি করে। আর সেটাই ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত করতে মূল ভূমিকা রাখে। শ্রদ্ধাভাজন গাফ্ফার চৌধুরীর হুবহু কথাটি উল্লেখ করতে না পারলেও মর্মার্থ হয়তবা বোঝা গেল। এই ‘রক্তাক্ত বাংলায়’ শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. অনুপম সেনের একটি প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে’ তিনিও উল্লেখ করেন বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ব্যবধান থাকলেও বিভেদ কিংবা সংঘর্ষ ছিল না। ভারতীয় দুর্ভেদ্য বর্ণাশ্রম প্রথা মানুষে মানুষে মেলামেশার অবাধ সুযোগ তৈরিতে প্রতিবন্ধতা আনলেও কোন ধরনের বিবদমান দ্বন্দ্ব কিংবা সহিংসতার পরিস্থিতি আসতে পারেনি। সেটা তো ধর্মের ক্ষেত্রে নয়ই বরং রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে। রাজ রোষানলে অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদও বিদ্যমান, কিন্তু তা সেখান অবধি বজায় ছিল। সাধারণ মানুষের নৈমিত্তিক জীবন প্রবাহে তার ছায়াও পৌঁছতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কসও ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে অভিমত ব্যক্ত করেনÑ ভারতীয় উপমহাদেশের ঘটনাপরম্পরা যতই আপাতসংষর্ঘ কিংবা বিধ্বংসকারী মনে হোক না কেন এসব যুদ্ধ, বিপ্লব, দিগি¦জয়, অন্তর্নিহিত বিরোধ উপরিভাগের নিচে নামেনি। অর্থাৎ ’৭১ -এর বাংলাদেশ যে সংগ্রামী অভিযাত্রায় নয় মাসের রক্তাক্ত ইতিহাস তৈরি করে তাকে যে শুধু ২৪ বছরের পাকিস্তানী সামরিক শাসন তথা একনায়কত্ব অতিক্রম করতে হয়েছিল তা কিন্তু নয়, তার চেয়েও বেশি দু’শ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের মর্মান্তিক, স্পর্শকাতর ঘটনা পার হতে হয়। ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক করাল গ্রাস থেকে নামেমাত্র বের হয়ে আমরা আবারও পাকিস্তানী নয়া ঔপনিবেশিক চক্রান্তে অবরুদ্ধ হলাম। বিশ শতকের প্রথম থেকে ব্রিটিশ খেদাও সংগ্রামী অভিযাত্রায় ঔপনিবেশিক শাসকই প্রথম আঘাত হানে ১৯০৫ সালে অবিভক্ত বাংলাকে কর্তন করে। তৎকালীন অনেক বিজ্ঞজনই এই অযাচিত বাংলা কর্তনকে মানতে পারেননি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠা-া লড়াইয়ে এর বিরুদ্ধে যে অভিনব প্রতিবাদ করেছিলেন তা আজও স্মরণীয়। কলকাতা শহরে রাখি পরানো থেকে শুরু করে মিছিল করাই শুধু নয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’সহ বহু দেশাত্মবোধক সঙ্গীত সাধারণ জনগণকে উপহার দিয়ে। এই বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলনের মতো সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সাংঘর্ষিক এক অধ্যায়ের। আছে ১৯০৬ সালের সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা। ১৯১১ সালে এই ব্যবস্থাকে রদ করা হলেও এই শতকের দ্বিতীয় দশকে শুরু হয় খেলাফত আন্দোলন আর গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলন। আর এসব সংগ্রামী চেতনার আড়ালে-আবডালে যা যথার্থ প্রভাব বিস্তার করে তাকে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বোধ। কারণ, পরবর্তী দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে ভিন্ন চেতনার দ্বিজাতিতত্ত্বের এক সর্বনাশা বিষক্রিয়া, যার অবধারিত পরিণতি ’৪৭-এর দেশভাগ। রাজনৈতিক ধারায় এমন বিবদমান সাম্প্রদায়িক অপসংস্কৃতি যখন সারা ভারতবর্ষকে নাড়িয়ে দেয় তখন সেখান থেকে বের হয়ে আসা কোন বিজ্ঞ কিংবা দক্ষ নেতৃত্বের পক্ষেও অসম্ভব ছিল। যার প্রভাব থেকে আমরা এখনও মুক্ত হওয়ার ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ধর্মীয় বোধ একেবারে নিজের এবং ভেতরের আত্মিক শুদ্ধতা। যার সামাজিক আবেদন ততখানিই যে পর্যন্ত তার সুস্থতা বজায় থাকে। বরং প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, ঐতিহ্যিক ভাব, চেতনা যা মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনের পথকে অবাধ ও নিরন্তর করে সেই অভিব্যক্তিগুলোই সমাজ চালনার সূচক হওয়া বাঞ্ছনীয়। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর আমাদের বাংলাদেশ এই ধরনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তৈরি করে বিভেদের বিধিনিষেধ পাল্টাতে শক্ত অবস্থানে আসতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্ববাঙালীর যে ঐকতানের সুর ঝঙ্কৃত হতে থাকে তাকে ভিত্তি করেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা ঋদ্ধ হয়। শুধু সাংস্কৃতিক অভিগামিতাই নয় আর্থ-সামাজিক বলয়ের সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জন একেবারে সামনে চলে আসে। সেই প্রেক্ষাপটে ’৬০-এর দশক ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের এক অবিমিশ্র গতিধারা যেখানে সর্ববাঙালীর মিলন সুর বেজে ওঠে। এই সংগ্রামে বাঙালী এগিয়ে যায় অদম্য নির্ভীকতায়, অজেয় মনোবল আর দেশপ্রেমের অবিচল নিষ্ঠায়। উপরে উল্লিখিত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক নেতৃত্ব সারা দেশকে এক ও অবিচ্ছিন্ন সুতায় গেঁথে দেয়। একেবারে মূল শেকড় থেকে নিজেকে তৈরি করা এই বীর বাঙালী আজ অবধি রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় তার সর্বোচ্চ আসনটিতে অক্ষয় ঐশ্বর্যের মতো বিরাজ করছেন। সুতরাং, বিজয়ের মাস কিংবা তার আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে এই অকুতোভয় বাঙালীর অপরাজেয় নেতৃত্বকে সবার উপরে স্থান দিতে না পারলে বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকেই যথার্থভাবে স্মরণ করতে আমরা ব্যর্থ হব। বহু কাক্সিক্ষত বিজয়ের দিন আসার আগ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর জাতিকে মেধা ও মননশূন্য করতে মেরে ফেলা হয় অনেক জ্ঞানী, গুণী ও প-িতকে। বিজয়ের উল্লাস বেদনা আর কষ্টের ভারে চাপা পড়ে যায়। এত কিছুর বিনিমিয়ে যে স্বাধীনতা এবং মুক্তির চেতনা তাকে আর কোনভাবেই লাঞ্ছিত, লুণ্ঠিত হতে দেয়া যাবে না। বিজয় নিশান ওড়াবার এই গৌরবান্বিত মাসে আরও এক জয়রথকে ব্যালটের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, লাখো শহীদের আত্মোৎসর্গ, মা-বোনের লাঞ্ছনার করুণ ইতিহাসকে সবার আগে চিন্তাভাবনায় নিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা তাঁর দশ বছরের স্বর্ণালী অধ্যায়কে যে মাত্রায় জনগণকে উপহার দিয়েছেন সে জায়গায় তার নির্ধারিত আসনটিকে আরও একবার শক্ত করতে হবে। বিজয়ের এই মহিমান্বিত পর্বে এটাই হোক সবার অঙ্গীকার। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যে স্বাধীনতার সূর্য সারা বাংলাকে আলোকিত করেছিল সেখান থেকে মাত্র সাড়ে তিন বছর পরের ইতিহাস অন্ধকারে ডুবে যেতেও সময় লাগেনি। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পটপরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই শুধু ধর্ষিত হয়নি স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালনে বিভীষিকাময় অধ্যায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মৌল ও জঙ্গীবাদের উত্থান, প্রতিপক্ষ অপশক্তির চরম দুঃসাহস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ন্যক্কারজনক সশস্ত্র বিধ্বংসী হামলা, সারাদেশে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ, সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আয়োজনের ওপর আক্রমণ চালানো, সব মিলিয়ে ২১টি বছর ছিল এক সাংঘর্ষিক ষড়যন্ত্রের বীভৎসতা। মাত্র দশ বছরের প্রধানমন্ত্রীর শাসনামল শুধু যে উন্নয়নের ধারা বহমান তা কিন্তু নয়; অপশক্তির হরেক রকম সশস্ত্র, বোমা নিক্ষেপের পৈশাচিকতা থেকেও আজ দেশ অনেকটাই মুক্ত। জনগণের মূল্যবান রায়ের বিনিময়ে নতুন যে সরকার নির্বাচিত হবে সেখানেও এসব বিষয় গুরুত্ব পাওয়া অত্যন্ত জরুরী। সংঘর্ষ আর ষড়যন্ত্রের দিকে কোনভাবেই দেশকে নিয়ে যাওয়া যাবে না বরং সুস্থ রাজনীতি আর পর্যায়ক্রমিক গণতন্ত্রের চর্চাকে সম্মান জানিয়ে প্রার্থী নির্বাচন দেশের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি সচেতন ভোটাররা এ সবই বিবেচনায় রাখবেন। লেখক : সাংবাদিক
×