ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গল্প

বিজয় পাল্টাবে না

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

বিজয় পাল্টাবে না

নাসরীন মুস্তাফা ॥ সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মোটা ভ্রু দেখে চমকে ওঠেন আকারি কুরোসাওয়া। ঠিক এই রকম ভ্রু তিনি আগেও যেন দেখেছেন। মানুষটার এই রকম গোল মুখে কুটিল দুটো চোখে কুতকুতে দৃষ্টি যেন তার খুব চেনা। মানুষটা কুটিলভাবে হেসে উঠতেই পুরোপুরি চিনে ফেললেন তিনি। ইংরেজী জানেন বেশ ভাল রকমের। তবে ভয় পেলে বা খুব চমকে উঠলে কি হয়? মায়ের ভাষাটাই তো বের হয়। তারও হলো। তিনি শুকনো গলায় ফ্যাসফ্যাস করে বললেন, এনেই জেপি মুঅঁ! আকারি কুরোসাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে বহু কাল ধরে। আমাদের কোম্পানির কাজ হচ্ছে সে কাজে সাহায্য করা। একটু একটু জাপানী জানি আমি। তাই আকারি কুরোসাওয়া এলে আমাকেই সঙ্গে থাকতে হয়। এতে সমস্যা হয়নি আমার। প্রায় সত্তর বছরের হাসিমুখের মানুষটার সঙ্গ আমারও ভাল লাগে। বেশ কয়েক বার সাক্ষাত হয়েছে বলে আকারি কুরোসাওয়া এখন আমার আংকেল। শুকনো গলায় ফ্যাসফ্যাস করে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলেন। আমি গলার স্বরে ভয় টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। এই কফি শপে আলো খুব চওড়া নয়। তবুও দেখতে এবং চিনতে আমারও কষ্ট হলো না। আমিও আমার মায়ের ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলাম প্রায়। এ কী করে হয়! মানুষটা চেয়ার টেনে নিল আমাদের টেবিলে। পরনের স্যুট-টাই ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল প্রায়ই। আকারি কুরোসাওয়া একটু সামলে নিয়ে বললেন, তুমি দেখতে একদম ইয়াহিয়া খানের মতো। পাকিস্তানের ডিকটেটর। আমি ভেবেছিলাম তুমিই ইয়াহিয়া খান। মানুষটা ভয়ানক করে হাসল। বলল, আমিই তো। আকারি কুরোসাওয়া ভাবলেন, জবরদস্ত একখানা ঠাট্টা বুঝি। মুচকি হেসে বললেন, আমার নাম আকারি কুরোসাওয়া। জাপানী চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া বিশ^খ্যাত হয়েছিলেন। নামে অনেক মিল থাকলেও আমি তো আর আকিরা কুরোসাওয়া নই। তেমনি, চেহারায় খুব মিল হলেও তুমি নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খান নও। ইয়াহিয়া খান ইতিহাসে একটাই। যে কাজ-কম্ম করে গেছে, তাতে আরেকটার দরকার নেই। মানুষটা হিস্হিস্ করে বলল, ইতিহাস আবার তৈরি হবে। আর তাই আমিই ইয়াহিয়া খান। সেই ইয়াহিয়া খান? যে কি না ২৫ মার্চ রাতে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের উপর গুলি চালাতে হুকুম দিয়েছিল! নয় মাস যার কারণে ত্রিশ লাখ বাঙালীকে শহীদ হতে হয়েছিল! আকারি কুরোসাওয়া ঘামছেন। জানতে চাই, তুমি কি ইয়াহিয়া খান টু? বলতে পার। বুঝলাম না। বুঝিয়ে বলছি বাছা। এরপর সেই মানুষটা আমাদের যা বোঝাল, তা বুঝে নেয়াটা সত্যিই খুব কষ্টের। ১৯৭১-এ পরাজয়ের পর ক্ষমতা হারায় ইয়াহিয়া খান। দীর্ঘদিন গৃহবন্দী ছিল। তখনি প্রস্তাবটা এসেছিল তার কাছে। ইতিহাস তৈরি করা হবে আবার। ১৯৮০ সালের কথা। মৃত্যুর আগে আগে তার শরীর থেকে কোষ নেয় ভয়ানক গবেষকরা। ক্লোন করা হয় ইয়াহিয়ার শরীরের কোষের। মায়ের গর্ভে জায়গা দেয়া হয় ক্লোনটার। জন্ম হয় ক্লোন ইয়াহিয়ার। এ নাকি ইতিহাস তৈরি করবে। আবার। ক্লোনটা বলে কি, এই ২০১৮ সালের হিসেব মতো আমার বয়স এখন আটত্রিশ মতো। সঠিক হিসেব ধরলে একশ’ এক। অনেক ঝানু এখন আমি। আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি চালাক। অনেক বেশি নিষ্ঠুর। ক্লোন ইয়াহিয়া খান কতটা নিষ্ঠুর, তা বোঝানোর জন্য আমার হাতটাই চেপে ধরল। মুচড়িয়ে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে চাইল। আকারি কুরোসাওয়া গায়ের সব জোর দিয়ে ছাড়াতে চেয়েও পারছে না। বেচারা প্রায় কেঁদে ফেলেছে আমার লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে। ক্লোন বদমাশটা তখন কী বলছে, তা শুনে তো আমি আরও ঠান্ডা হয়ে গেলাম। বলছে, আমি নাকি গাদ্দার বাঙাল। ও নাকি আমাকে ছাড়বে না। কোন বাঙালীকে ছাড়বে না। কফি শপের ওয়েটাররা একটু আধটু তাকাচ্ছিল। তবে এগিয়ে এল না। মনে হয়, বিদেশী দেখে আগাল না। বাগড়া দিতে গিয়ে ঝামেলা হয় কি না, তা-ই ভাবছে। আমাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসা আরও দুই স্যুট পরা মানুষ এল তখন। এদের দেখে ওয়েটারগুলো চলে গেল একদম পেছনে। দুই স্যুট পরার একজন বাজখাই গলা উদারাতে নামিয়ে জানতে চাইল, হেল্প? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে গিয়ে বলতে পারলাম না। কেননা, এই মানুষটা পুরো বড় মানুষ না। কিশোর বয়সের এক মানুষ সে। দেখতে একদম জেনারেল নিয়াজীর মতো। সেই নিয়াজী, যে ছিল ১৯৭১-এ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান। দেদার মানুষ মেরেছে। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল বলে ওর রাগ নাকি এখনও যায়নি। স্যুট পরা বাকিটা বাঁকা হাসি হেসে দাঁড়ায়। এও বড় মানুষ নয়। এও কেবল কিশোর। তার কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে জমে বরফ হয়ে যান আকারি কুরোসাওয়া। কেননা, এটা একদম দেখতে টিক্কা খানের মতো। সেই টিক্কা খান, যে কি না এই বাঙলার মাটি রেখে বাঙালীদের সবাইকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই টিক্কা খান, যাকে সবাই চেনে কসাই হিসেবে। বুঝলাম, এগুলোও ক্লোন। এতগুলো ক্লোন বদমাশ ইতিহাস তৈরি করবে? আবার? কার বুদ্ধি এগুলো? কে আছে এই পরিকল্পনার পেছনে? ভাবতে থাক, কে আছে এসবের পেছনে, তা নিয়ে তুমি ভাবতে থাক। ভাবতে ভাবতে স্বর্গে পৌঁছে যাবে। কেননা, আমরা আবার এক হয়েছি। বলল ইয়াহিয়া খান। ক্লোন বয়সের হিসেবে নিয়াজীর বয়স চৌদ্দ আর টিক্কা খান নাকি মাত্র ষোলো। কিশোর বয়সের কাউকে ছোট বললে রেগে যায় না? আকারি কুরোসাওয়া সে রকম বলেই রাগিয়ে দিলেন। বলছিলেন, এইটুকুন বয়সেই তোমরা বখে গেছ? ছি! টিক্কা খান ধমক দিয়ে বলে, গত জন্মের হিসেবে সে-ই নাকি বাকি দুইজনের চেয়ে বড়। ১৯৭১-এ যদি সে নেতা থাকত, তাহলে নাকি হারতে হ’ত না। মাথামোটা ইয়াহিয়া আর ডরপুক নিয়াজীর কারণে হার মানতে হয়েছিল। সেই হারের পর অনেক নাকি কেঁদেছে সে। ক্লোন জন্মেও কান্না থামেনি। জেদ বরং আরও বেড়েছে। টিক্কা খানের হাম্বিতাম্বি রাগিয়ে দিল ইয়াহিয়া খান আর নিয়াজিকে। কিশোর নিয়াজী ঠোঁট ফুলিয়ে বলছে, আমি মোটেও ডরপুক না। আগেও ছিলাম না। বিচ্ছু মুক্তিযোদ্ধাগুলো নেহাত ভয় দেখাত বলে কাপড় নষ্ট হয়ে যেত। ইয়াহিয়া রেগে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে টিক্কার মাথায় চাঁটি মেরে বলে, বড়দের সঙ্গে আদ্দপ করে কথা বলতে হয়! নিয়াজীও চাঁটি মেরেছিল অন্য পাশ দিয়ে। দুই চাঁটিতেই তেলে বেগুনে জ¦লে উঠে টিক্কা হয়ে গেল টিকিয়া কাবাব। বুক চিতিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। বলল, শক্তির পরীক্ষা হয়ে যাক। যাক্! কী সেই পরীক্ষা? কুটিল টিক্কা আমাকে দেখিয়ে বলে, এই বাঙালীকে যে সবচেয়ে জোরে আছাড় মারতে পারবে, সে-ই নাকি জিতবে। আমাকেই নাকি আছাড় মারতে হবে। কেননা, ১৯৭১-এ আমার বাপ-দাদারা ওদেরকে আছাড় মেরেছিল। শুধু কি আছাড়? গলা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে পাছায় লাথি দিয়েছিল কষে। এই প্রস্তাবে বাকি দু’টোরও খুব সায় মিলল। বাঙালীকে আছাড় মারার জন্যই নাকি ওদেরকে ক্লোন করা হয়েছে। কেননা, বাঙালীকে আছড়ে মাটিতে ফেলতে না পারলে জেতা অসম্ভব। ইতিহাসও দখলে নেয়া যাবে না। আকারি কুরোসাওয়া বুড়ো মানুষ। ভালবাসেন আমায়। আমার পিঠে হাত রেখে নাম ধরে ডাকেন। বলেন, বিজয়! তিনি তারপর বলেছেন, আমার দেশ অনেক কিছু করেছে। অনেক সম্পদ আমাদের। কিন্তু জয়ের আনন্দ আমাদের নেই। আমরা পরাজিত শক্তি হয়েই পথ চলছি। কিন্তু, তুমি তো বিজয়। তোমার দেশ যুদ্ধে বিজয়ী দেশ। তোমাকে পরাজিত করা যায়নি। তোমাকে পরাজিত করা কি যাবে, বল? আমার দুই হাত আর দুই পা-ই ততক্ষণে জায়গা মতো চলে গেছে। তিন ক্লোনকে এক সঙ্গে গলা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে পাছায় কষে লাথি মারতে মারতে বলেছিলাম, নামের অনেকগুণ আঙ্কেল। বিজয় মানে বিজয়। তখনও ছিল। এখনও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। আমি এ্যাকশন শুরু করার পর ওয়েটারগুলো ছুটে এসে হাত আর পা সবই লাগিয়েছিল। ততক্ষণে আকারি কুরোসাওয়া পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশদের বড়কর্তা যিনি এলেন, তিনি আবার আকিরা কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্রের বেজায় ভক্ত। ছুটে এসে আকারি আঙ্কেলের হাত দুই হাতে চেপে কেবলি জাপানী কায়দায় বো করতে লাগলেন। বেচারা মায়ের ভাষাটও ভুলে গেলেন বলে কথা আর বলতে পারলেন না। উ আ যা বলছিলেন, তা জাপানী যে না, সে ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত। ফুটনোট এতক্ষণ যা বললাম, তা কি সত্যিই ঘটেছিল? ঘটবে কি আদৌ? খুব সাবধানে পরখ করি সব মুখ। পথেঘাটে, সব জায়গায়। করতেই হবে, তাই না? আমার দেশকে পরাজিত করার পরিকল্পনা যদি কেউ করে থাকে! বলা তো যায় না! দেশকে তো আর একলা বিপদে ফেলে রাখা যায় না! অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×