ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গার একপাড়ে নৌকা, অন্যপাড়ে ধানের শীষ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

 বুড়িগঙ্গার একপাড়ে নৌকা, অন্যপাড়ে ধানের শীষ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাড়ের তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত ঢাকা-২ আসনের ভোটও ভাগাভাগি হয়েছে এই নদীর জলধারায়। এক পাড়ের কামরাঙ্গীরচর যেমন আওয়ামী লীগের নৌকার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, অন্যপাড়ের কেরানীগঞ্জ ও সাভারের এলাকাগুলো তেমনই বিএনপি অধ্যুষিত। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমানের এলাকা কেরানীগঞ্জ বরাবরের মতো ধানের শীষের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়রা বলছেন, সেখানকার ভোট পেতে নৌকার প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে দ্বন্দ্ব মেটাতে হবে দলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে পরিচিত উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সঙ্গে। অন্যদিকে কামরাঙ্গীরচর এলাকার ভোট টানতে এলাকাবাসীকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে হবে ধানের শীষের প্রার্থী আমানপুত্র ইরফান ইবনে আমান অমিকে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারের দ্বিতীয় দিনে কামরাঙ্গীরচর থানার সঙ্গে কেরানীগঞ্জ ও সাভারের অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত ঢাকা-২ আসনে ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। কামরুল টানা দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পালনের পর তৃতীয়বার এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন। ১৯৯১ সাল থেকে তার আগ পর্যন্ত এই এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন আমান। মামলার কারণে ভোটের মাঠ থেকে আমান ছিটকে পড়ায় তার ছেলেকে দলের টিকেট দেয় বিএনপি। কেরানীগঞ্জ উপজেলার হযরতপুর, কলাতিয়া, তারানগর, শাক্তা, কালিন্দী, রোহিতপুর ও বাস্তা ইউনিয়ন, হাজারীবাগের সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কামরাঙ্গীরচর থানার ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড এবং সাভার উপজেলার আমিনবাজার, তেঁতুলঝোড়া ও ভাকুর্তা ইউনিয়ন রয়েছে ঢাকা-২ আসনে। বুধবার কেরানীগঞ্জের হযরতপুর, কালিন্দী, শাক্তা এবং সাভারের আমিনবাজার ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নে ঘুরে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে রমরমা প্রচার দেখা যায়। সেখানে কামরুলের কিছু পোস্টার দেখা গেলেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। অন্যদিকে কামরাঙ্গীরচর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডের ঘুরে ধানের শীষের পোস্টারের দেখা মেলেনি একটিও। তার বিপরীতে নৌকার পোস্টারে ছেয়ে ছিল ওখানকার বিভিন্ন এলাকা। কামরাঙ্গীরচরের ঈদগাহ মাঠে প্রার্থী কামরুলের নির্বাচনী জনসভা ঘিরে নৌকার মিছিলে মিছিলে সরগরম ছিল পুরো এলাকা। নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কামরুল এবং অমি দুই এলাকাকে অনেকটা ভাগাভাগির চোখেই দেখছেন। কামরাঙ্গীরচরের জনসভায় গিয়ে আওয়ামী লীগের কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘হযরতপুর ইউনিয়ন তো আমান উল্লাহ আমানেরই ইউনিয়ন। কোন ইউনিয়ন নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চাই না। কামরাঙ্গীরচর তো আমাদের ঘাঁটি। সাভারেও আমাদের অবস্থা খুবই ভাল। কেরানীগঞ্জেও আমাদের অবস্থা কিন্তু ভাল।’ অন্যদিকে বিএনপির নবীন প্রার্থী ইরফানের ভাষ্যে কেরানীগঞ্জকে বেশি প্রাধান্য দেয়ার কথাই ফুটে উঠে। বুধবার সকালে হযরতপুর ইউনিয়নে গণসংযোগে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবা যেভাবে কেরানীগঞ্জের উন্নয়ন করেছে, সেভাবে কেরানীগঞ্জের উন্নয়ন করব আমি। সাভার ও কামরাঙ্গীরচরের উন্নয়নও আমরা করব।’ ১৯৭৭ সাল থেকে কেরানীগঞ্জে ও কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে একে এম গোলাম মোস্তফার। বরিশালের গোলাম মোস্তফা শিক্ষকতা চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে চার কাঠা জমির ওপর টিনশেড বাড়ি করে কামরাঙ্গীরচরের নবীনগরের তিন নম্বর রোডে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বুড়িগঙ্গার দুইপারের ভোটের হিসাব নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় অবসরপ্রাপ্ত এই স্কুলশিক্ষকের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচরে অনেক অনেক এগিয়ে নৌকা মার্কা। কারণ, এখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার ভোটারের মধ্যে ৫০ শতাংশ ভোটার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার, ৩০ শতাংশ ভোটার বরিশালের, কিছু কুমিল্লা জেলার, আর বাকিরা স্থানীয়। ফরিদপুরের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ করেন, বরিশালের মানুষ বিএনপি বেশি করলেও কামরাঙ্গীরচরে যারা বসবাস করছেন, তারা আওয়ামী লীগ করছেন।’ কামরাঙ্গীরচরে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগের বলে হিসাব দেখান তিনি। এর বিপরীতে কেরানীগঞ্জের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট বিএনপির বলে ভাষ্য তার। অন্যদিকে সাভারের পরিস্থিতি ‘৫০-৫০’ মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘স্থানীয় মনির চেয়ারম্যানের জন্য কামরাঙ্গীরচরে বিএনপির ‘কিছু’ সমর্থন আছে। তবে তিনি বিভিন্ন নাশকতায় মামলায় জর্জরিত থাকায় সেসব ভোট অকার্যকর। মাঠে নাই কেউ।’ একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-২ আসনের মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৩১৩ জন। তারমধ্যে কেরানীগঞ্জের অংশে ২ লাখ ২৩ হাজার। বাকি ভোট কামরাঙ্গীরচর ও সাভারের আমিন বাজার, ভার্কুতা ও তেঁতুলঝোড়ায়। প্রধান দুই প্রার্থী কামরুল ও অমির সঙ্গে ওই আসনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ‘বটগাছ’ প্রতীকে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আতাউল্লাহ, ‘হাতপাখায়’ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জহিরুল ইসলাম, ‘লাঙ্গলে’ জাতীয় পার্টির শাকিল আহমেদ শাকিল এবং ‘কাস্তে’ প্রতীকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সুকান্ত শফি চৌধুরী কমল। কামরুলের সামনে শাহীন চ্যালেঞ্জ ॥ ঢাকা-২ আসনে খাদ্যমন্ত্রী কামরুলের সঙ্গে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শাহীন আহমদ। কেরানীগঞ্জের ভোটাররা বলছেন, তার সঙ্গে সুস্পষ্ট যে বিরোধ কামরুল ইসলামের ছিল, সেটা মিটিয়ে ভোটারদের টানতে পারলে কেরানীগঞ্জেও ভাল অবস্থান তৈরি করতে পারবেন কামরুল। হযরতপুরের একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘শাহীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে এলাকাবাসীর যোগাযোগ ভাল। এর বিপরীতে কামরুল ইসলাম সাহেবের নজর এই এলাকায় কম। তাকে এখানকার ভোট পেতে হলে শাহীন চেয়ারম্যানকে হাতে রাখতেই হবে।’ এদিকে, কামরুল ইসলামকে প্রার্থী করায় শাহীনের সঙ্গে যে ‘মতবিরোধ’ তৈরি হয়েছিল, তা ইতোমধ্যে মিটিয়ে ফেলা হয়েছে দাবি করেন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন সরকার। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিরোধ ও মনোমালিন্য হয়ত ছিল, আমরা বসে সেটি মিটিয়ে ফেলেছি। এখন কোন সমস্যা নাই।’ অন্যদিকে নৌকার পক্ষে কাজ করতে একাট্টা আছেন বলে মন্তব্য করেছেন শাহীন আহমদ। তিনি বলেন, ‘নৌকা স্বাধীনতার প্রতীক। নৌকার সঙ্গে সারাজীবন ছিলাম, সারাজীবন আছি এবং থাকব। নৌকাকে বিজয় করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমার যা যা করার তা আমি করছি।’ কামরুলের সঙ্গে তার বিরোধের বিষয়টি ‘নিতান্তই প্রোপাগা-া’ বলে মন্তব্য করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। প্রার্থী না থেকেও ‘আছেন’ আমান ॥ মামলার কারণে ২০০৮ সালের মতো এবারও ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান। তার জায়গায় ছেলে অমি মনোনয়ন পেলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন আমানেরই সঙ্গে। কেরানীগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে আমানের নামেই ঘুরে ফিরছে। কেরানীগঞ্জের কানারচর এলাকার বিএনপিকর্মী মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, ‘এখানে আমান ভাইই সব। তিনি যে রাস্তাঘাট করছেন, সেই রাস্তাঘাট-ব্রিজ করছিলেন, সেটাই আছে। আমান ভাইয়ের এলাকা হওয়ায় কামরুল সাহেব এদিকের খবর রাখেন নাই।’ আলীপুর ব্রিজের একপ্রান্তের দোকানে চায়ের আড্ডার ভোটাররাও কেরানীগঞ্জের উন্নয়নকারী হিসেবে আমানের কথাই বলেন। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে অবিভক্ত কেরানীগঞ্জের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ’৯০ এর ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টুকে হারিয়ে ওই আসনে প্রথমবারের মতো এমপি হন তিনি। নৌকার প্রার্থী কামরুলও মনে করেন, আমি প্রার্থী হলেও ভোটের মাঠে ’প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা’ আমানের সঙ্গেই হচ্ছে তার। এখানে আমান উল্লাহ আমানের ছেলে প্রার্থী। তরুণ ছেলে, তরুণ ব্যারিস্টার। আসলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, আমান স্নেহের আমানের সঙ্গে। ছেলের পক্ষে নির্বাচন কিন্তু আমান উল্লাহ আমানই পরিচালনা করবেন।’ বুধবারের গণসংযোগের সময় বাবার দোহাই দিয়েই ভোট চাইতে দেখা যায় তার ছেলে অমিকে। হযরতপুর এলাকায় ছাদখোলা গাড়িতে চড়ে হ্যান্ডমাইকে ভোটারদের সমর্থন চান তিনি। এ সময় ঢাকা জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অমিকে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘আপনাদের হযরতপুরের আমান সাহেবের ছেলে আমি, এবার ধানের শীষের প্রার্থী। আমার জন্য দোয়া করবেন। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিবেন।’ এর মধ্যে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আধুনিক কেরানীগঞ্জ। তিনি যে কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারেননি, সেগুলো সমাপ্ত করার চেষ্টা করব।
×