ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

 চলে গেলেন চলচ্চিত্রকার   আমজাদ  হোসেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা আমজাদ হোসেন আর নেই (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর দুইটা ৫৭ মিনিটে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী আর দুই ছেলেকে রেখে গেছেন। মৃত্যুর খবরটি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল। তিনি বলেন, আমার ভাই সোহেল আরমান সেখানে আছে। আমি ঢাকা থেকে সব সময় বাবার খোঁজ নিচ্ছিলাম। নিউরোসাইট বাদে শরীরের অন্যান্য সমস্যা উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এমন দুঃসংবাদ শুনতে হবে ভাবতে পারছি না। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও অভিনয়শিল্পী আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি বলেন, স্বীয় কর্মের মাধ্যমে তিনি মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। বর্ষীয়ান এ নির্মাতার ১৮ নবেম্বর সকালে ব্রেন স্ট্রোক হয়। এর পরই তাকে তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন তিনি। হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসক শহীদুল্লাহ সবুজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল তার। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে ১৯ নবেম্বর থেকে নিউরো মেডিসিন বিভাগের প্রধান, সার্জারি বিভাগের প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান, আইসিইউ বিভাগের প্রধানসহ ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা চলছিল। এই নির্মাতার শারীরিক অসুস্থতার খবর শুনে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মাথায় তার চিকিৎসার সব দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এ্যাম্বুলেন্স বাবদ ২২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং চিকিৎসার জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ লাখ টাকা প্রদান করেন। আমজাদ হোসেনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭ নবেম্বর রাত ১টার দিকে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে আমজাদ হোসেন নিউরো সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার টিরা ট্যাংভিরিয়াপাইবুনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। বুধবার দোদুল জনকণ্ঠকে জানিয়েছিলেন, বাবার প্রেসার খুবই লো। প্রেসার ওঠা-নামা করছে। কিডনির ক্রিয়েটিনিন লেভেল, যেটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল সেটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। হার্টবিট ঠিক আছে। তার হার্ট স্ট্যাবল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছিল। আর ইনফেকশনগুলো বাড়তে দেয়া হচ্ছে না। কিডনি ও লাং ইনফেকশন কন্ট্রোলে আছে। ডাক্তাররা হাত ও পায়ের এক্সটারনাল ইনফেকশন কন্ট্রোলে নিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, নিউরো সার্জারি ডাক্তার টিরা ও মেডিসিনের ভ্রংসা এক পর্যায়ে আমাদের বলেছিলেন, বাবার হাত কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু তারপরও বাবা বেঁচে থাকবেন কিনা এ নিশ্চয়তা তারা দিতে পারেননি। আমরা বলেছিলাম তা হলে হাত কাটতে দেব না। কেননা যে হাত দিয়ে বাবা উপন্যাস লিখেছেন, বিখ্যাত বিখ্যাত ছবি তৈরি করেছেন, সেই হাত থাকবে না, এই অবস্থায় বাবা আমাদের মাঝে থাকবেন এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। মেডিসিনের মাধ্যমে বাবার সেসব জায়গা এখন অনেক উন্নতির দিকে। এখন আর হাত কাটা লাগবে না। তবে নিউরো সাইট এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে। সেটাকে মেডিসিন দিয়ে নিরাময় করার চেষ্টা চলছে। এই সাইট এখনও ইমপ্রুভ হয়নি। বাবা এই হাসপাতালের ৫৩০ নম্বর রুমে আছেন। কিংবদন্তি এই নির্মাতার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সংস্কৃতি অঙ্গনে। চিত্রনায়িকা ববিতা বলেন, আমি আমজাদ ভাইয়ের একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছি এবং ব্যবসাসফলও হয়েছে ছবিগুলো। ওনার ছবির মতো ব্যবসাসফল এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি কম নির্মাতাদের ছবিতে ঘটেছে। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল- উনি সবার সঙ্গে ছিলেন আন্তরিক। আমি অনেক ছবিতে অভিনয় করেছি কিন্তু জহির ভাইয়ের পরে ওনাকে প্রাধান্য দিতেই হবে। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে ওনার মতো আর কোন ব্যক্তিত্ব আসবে কিনা আমার জানা নেই। ওনার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। নির্মাতা এসএ হক অলীক বলেন, অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের ইন্ডাস্ট্রির। উনার শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না। ওনাকে দেশে আনার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট, জামালপুরে। শৈশব থেকেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত হন। প্রথমেই তিনি অভিনয়ে নিজেকে তুলে ধরেন মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে। এর পর পরই তিনি অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে। এর পরের ইতিহাস একেবারেই অন্যরকম। সালাহউদ্দিন আমজাদ হোসেনের লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে আমজাদ হোসেন নায়ক হিসেবে অভিনয়ও করেন। এর পর তিনি জহির রায়হানের ইউনিটে কাজ শুরু করেন। এভাবেই দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে ১৯৬৭ সালে তিনি নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। নাম ‘জুলেখা’। এর পর নূরুল হক বাচ্চুর সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন ‘দুই ভাই’। তার পরিচালিত ব্যাপক দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র হচ্ছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ও ‘গোলাপী এখন বিলেতে’। গুণী এই পরিচালক ১৯৭৮ সালে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (১৯৯৩) ও স্বাধীনতা পুরস্কারেও ভূষিত করে।
×