ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পউষ এলো গো! পউষ এলো... ঐ যে এলো গো

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

পউষ এলো গো! পউষ এলো... ঐ যে এলো গো

মোরসালিন মিজান ॥ ‘পউষ এলো গো!/ পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে।/ ঐ যে এলো গো...।’ এসেছে পৌষ। আজ শনিবার ১ পৌষ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। শুরু হলো শীতের কাল। আজ থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু হলেও, শীত শীত অবস্থা চলমান ছিল অনেকদিন ধরে। দিন যত গেছে, বেড়েছে শীত। আর তার পর আনুষ্ঠানিক শুরু। কবিগুরুর ভাষায়- শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে/ শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে...। শীত উৎসবে সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরুর ভাষায়- পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয়...। পৌষের প্রকৃত রূপ গ্রামেই দেখা যায়। এ সময় নানা উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের কাছে নত নাগরিক সমাজ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজন করে পৌষ মেলার। পিঠা উৎসব চলে মাসজুড়ে। বৃষ্টির আশঙ্কা না থাকায় অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানও বেড়ে যায়। সে পরে হবে। শীত নিয়ে আবহাওয়া অফিসের ব্যাখ্যাটা আগে জেনে নেয়া যাক। আবহাওয়াবিদদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ বিষুবরেখার উত্তরে। প্রায় সাড়ে ২৩ ডিগ্রী অক্ষাংশে। কিন্তু শীতকালে অবস্থান পরিবর্তন করে সূর্য বিষুবরেখার দক্ষিণে চলে যায়। দক্ষিণে কিছুটা হেলে থাকে। দিন ছোট হয়। বড় হতে থাকে রাত। এর ফলে শীতের প্রকোপ বাড়ে। বাংলাদেশে যখন শীতকাল, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে দেশে তখন গ্রীষ্ম। ওসব দেশে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উত্তর গোলার্ধ থেকে ঠান্ডা বাতাস দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফশীতল বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে যে ঠান্ডা বাতাসের প্রবল প্রবাহ সৃষ্টি হয় তা শৈত্যপ্রবাহ নামে পরিচিত। এ সময় তীব্র ঠান্ডা অনুভূত হয়। তবে মাঘের শীত সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বলা হয়ে থাকে, মাঘের ভয়ে বাঘও পালায়। এদিকে, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য বিস্তর। কোন কোন দেশে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীতে নেমে আসে। খুব কাছের দেশ চীনেও তাপমাত্রা মাইনাস নয়/দশ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসে। মেরু অঞ্চল বা এন্টার্কটিকার কথা কথা তো বলাই বাহুল্য। অথচ বাংলাদেশে তাপমাত্রা ছয় থেকে পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে খুব একটা নামে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশে শীত অনেক বেশি উপভোগ্য। সবার প্রিয় হলেও শীত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে গ্রামীণ জীবনকে। পৌষে কৃষকের ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়। হাতে তেমন কাজ থাকে না। সবাই উৎসব আনন্দে মাতে। নতুন ধান থেকে পাওয়া চালে ঘরে ঘরে চলে পিঠাপুলির আয়োজন। এখন শহর ঢাকার ফুটপাথেও বিক্রি হচ্ছে গরম গরম ভাপা পিঠা। চিতই পিঠা। পৌষে শহর ঢাকায় ঘন ঘন পিঠা উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। এবারও হবে। পৌষের প্রকৃতি অদ্ভুত সুন্দর। প্রতিবারের মতোই নতুন রূপে সেজেছে। বদলে গেছে অনেক ধরাবাঁধা নিয়ম। এখন সকাল হলেই সূর্যালোকের দেখা মেলে না। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। রাতে শিশির ঝরছে। প্রকৃতির এ রূপ বর্ণনা করেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন: শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...। অন্য কবির কবিতায় বর্ণনাটি এরকম- বিষাদের প্রতিমূর্তি হে শীত, সবুজের পোষাক খসিয়েছ/ নিয়েছ জড়িয়ে কুয়াশার শুভ্র চাদরে তপসীর সাধনায়...। পৌষে এই কুয়াশা এত হয় যে প্রতিদিনের সূর্য ওঠা ভোরও দেখা যায় না। সূর্যের আলোর জন্য প্রতিক্ষা করতে হয়। সুকান্ত তাই লিখেছিলেন: সকালের এক-টুকরো রোদ্দুর-/ এক-টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।/ ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই-/এক-টুকরো রোদ্দুরে তৃষ্ণায়...। গ্রামের সাধারণ কৃষক অবশ্য সূর্যের অপেক্ষা করেন না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আইল্যায় হাত শেকে নেন। এভাবে যেটুকু সম্ভব উষ্ণতা সঞ্চয় করে চলে যান ফসলের মাঠে। শীতে ফসলের মাঠও যেন নতুন প্রাণ পায়। প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে বললে, এ সময় সরিষার ক্ষেতে চোখ আটকে যায়। চোখ ধাঁধানো রূপ, রঙের খেলা মনে করিয়ে দেয় শীত এসেছে। খেজুরের রসে ভরে ওঠে মাটির কলসি। ম ম গন্ধ ছড়ায়। শীতের হাওয়ায় কাঁপন ধরে আমলকীর বনে। কবিগুরুর ভাষায়- শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।/ পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে...। শীতকালে ফুলেরাও যেন বাড়তি আবেদন নিয়ে হাজির হয়। সৌন্দর্যের সবটুকু মেলে ধরে। মৌসুমি ফুলে ভরে ওঠে বাগান। হলুদগাঁদা ফুল এরই মাঝে শীতকে স্বাগত জানিয়েছে। আর গোলাপ তো ফুল নয় শুধু, বিশেষ জাত। খুব প্রিয় গোলাপ সারা বছরই ফোটে। তবে এই এখন মৌসুম। গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণে ক্রমশ চারপাশ ভরে উঠছে। ফুটছে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগফুল। মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যমুখী। আকাশের দিকে তাকিয়েও এখন অনুমান করা যায়, শীত এসেছে। সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে শীতের পাখিরা। প্রায় সারা দেশের বনে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের শাখায় এখন উৎসব চলছে পাখিদের। দেশীয় পাখিদের সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যোগ দিয়েছে অতিথি পাখিরা। কবির ভাষায়Ñ শীতের পাখিরা বৈকাল থেকে উড়ে আসে নাতিশীতোষ্ণ দেশে...। পরিযায়ী পাখিদের ওড়াউড়িতে মুখর এখন সুনামগঞ্জের টাঙুয়ার হাওর। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমিতে বিচরণ করছে ৫১ প্রজাতির পাখি। ঢাকার পাশেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখতে প্রতিদিনই সেখানে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। তবে, হতদরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের জন্য শীত এখনও ভোগান্তির। দিনে ক্ষুধার জ্বালা আর রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের জীবন। এসব হতভাগ্যের পাশে দাঁড়ানো খুব জরুরী। আমরা কি দাঁড়াচ্ছি?
×