ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ যেন স্বপ্নের গোলাপপুরী...

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

এ যেন স্বপ্নের গোলাপপুরী...

শীত আসছে। শহুরে জীবনে কাঁপুনি না লাগলেও শহরের বাইরে কিন্তু শীতকুমারী বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাংলার শীত মানেই তো অপরূপ প্রকৃতির বিস্ময়কর রূপলীলা। ধনে না হলেও মনেপ্রাণে ধনী বাঙালী অপেক্ষায় থাকেন- শীতে কোথায় কোথায় গিয়ে সৌন্দর্যের সুরাপান করা যায়। এমনি আমরা বরাবর প্রত্যক্ষ করে আসছি। তাই তো এই সময়কে আমরা পর্যটনের সময় বা ঋতু বলে থাকি। আসছে পৌষ মাস। পিঠা-পার্বণ ও বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য বেড়ানোর ভরমৌসুম অধির অপেক্ষা করছে। ভ্রমণপ্রেমীরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন কোথায় যাবেন? কেউ ঠিক করে ফেলেছেন আবার কেউ বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। আমি বলব, ঢাকার অদূরে নয়নাভিরাম একটি জায়গার কথা। সাভারে বিরুলিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত তুরাগ নদীর তীরে এই গ্রামটি যেন গোলাপ ফুলের চাদরে ঢাকা। সে রকম একটি গ্রামে ঘুরে এলাম। শহুরে ক্লান্তিময় এই কংক্রিটের মধ্যে জীবনটাকে কিছুটা রেহাই দিতে চলে গেলাম সেই গোলাপ গ্রামে। তবে অনেকে হয়ত সময়-সুযোগের অভাবে অথবা খরচের কথা ভেবে কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসতে চান। যারা ঢাকা বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকেন, তাদের জন্য স্বল্প খরচে একদিনে বেরিয়ে আসার মতো একটি জায়গা হলো গোলাপ গ্রাম। অসম্ভব সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ যেন বার বার পিছু টানে। গ্রামের আঁকা-বাঁকা পথের যেখানেই চোখ যায় শুধু সারি সারি লাল গোলাপ। লাল গোলাপের সৌন্দর্য আর সুবাস যেন গ্রামটিকে করে তুলেছে রূপবতী। গোলাপ গ্রাম মূলত শুরু হয় সাদুল্লাহপুর ট্রলারঘাট থেকে উত্তরে শ্যামপুর নামক গ্রাম থেকে। এই গ্রামের স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস গোলাপ চাষ। গ্রামের প্রায় ৮০-৯০ ভাগ মানুষ গোলাপ চাষ করে থাকেন। গ্রামের উঁচু জমিগুলোতে গোলাপ চাষের জন্য উপযুক্ত। যতই হেঁটে যাওয়া যায় চোখে পড়ে শুধু লাল গোলাপের বাগান। এখানে লাল গোলাপের পাশাপাশি সাদা গোলাপ, হলুদ গোলাপ, গ্যালারি বা গ্লাডিওলাস আর জারবেরা ফুলের চাষ হয়। সেখানে গোলাপ বাগানগুলোর মাঝে মাঝে বসানো আছে ছাউনি। দর্শনার্থীরা এখানে বসতে পারেন আর ছবিপ্রেমীরা ক্যাপচার করে নিতে পারেন প্রিয় মুহূর্তগুলো। সারা বছর এ গ্রামে গোলাপের চাষ হলেও ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের বেচা-বিক্রি বেশি হয়। গোলাপ ক্ষেত ঘুরতে গেলে কথা হয় এই গ্রামের গোলাপ চাষী মোহাম্মদ ইখলাস মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ১৮ বছর এ গ্রামে গোলাপ চাষ করেন। প্রায় ৩০ শতাংশের মতো জমিতে তার বছরে খরচ হয় ৮০ হাজার টাকা তবে লাভ মোটামুটি সন্তোষজনক। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিতে তাদের একটু সমস্যায় পড়তে হয়। গোলাপের ছোট চারাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, ‘আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে কীটনাশক না থাকায় ফুলের চাষ খুব ভাল হয় না। ফুল কাটারের অভাবে সবজি কাটার ব্যবহার করে থাকি। যা আমাদের গাছের জন্য খুব ক্ষতিকর।’ সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখা যাবে যদি সকাল ৯টার মধ্যে চলে যাওয়া যায়। স্থানীয় চাষীরা তাদের নিজেদের সুবিধার্থে নিজেদের গ্রামেই গড়ে তুলেছেন ফুলের হাট। শ্যামপুর বাজারে সন্ধ্যা ৭টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ হাট বসে। ঢাকার শাহবাগ, আগারগাঁও, খামারবাড়ি এসব এলাকার বড় বড় ফুল ব্যবসায়ী কিনে নিয়ে যান পাইকারি দরে। দেশের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এই গ্রামেই মিরান্ডা প্রজাতির গোলাপের চাষ হয়। চাষীরা ৫০ পিস গোলাপ বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। একই গ্রামে অন্যদিকে অনেক চাষী জারবেরা ফুলের চাষ করে থাকেন। চোখজুড়ানোর মতো সুন্দর এই বাগানগুলো। অনেক যত্নের সঙ্গে চাষীরা এই ফুলের চাষ করেন। ছাউনি দিয়ে ঘিরে রাখেন পুরো বাগান। যেন রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা, শিশির কিছুু না লাগে। কারণ খুব রোদে এ ফুলের রং নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ধরনের ওষুধ প্রয়োজন হয়। এ ফুল চাষে ব্যয় বেশি হওয়াতে তারা বেশি দামে ফুল বিক্রি করে থাকেন। ঢাকার অদূরে এ গ্রামটি হওয়ায় একদিনের ছুটিতে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। কথা হয় একজন দর্শনার্থী আনিসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, এসেছেন ছোট বোন সাফরোনা রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এ জায়গাটির ব্যাপারে তিনি আগে খুব শুনেছেন, তবে সময়-সুযোগের অভাবে আসা হয়নি। তবে যতটুকু শুনেছেন তার চেয়েও বেশি সুন্দর এ গ্রামটি। পরিবার নিয়ে ঘুরে আসার জন্য খুব সুন্দর জায়গা এটি। যারা চাচ্ছেন এই যান্ত্রিক জীবনটাকে একটু ছুটি দিতে, তারা কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য চলে যেতে পারেন সেখানে। আপনি চাইলে হেঁটেই পুরো গ্রাম ঘুরে দেখতে পারবেন। ছবিপ্রেমীদের জন্য এ জায়গাটি তুলনাহীন। কীভাবে যাবেন : বেশ কয়েকটি রুটে গোলাপ গ্রাম বা সাদুল্লাহপুর যাওয়া যায়। রুট-১ : যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১ যাওয়ার বাস সার্ভিস আছে। এছাড়া মিরপুর এক নম্বর সেকশন অথবা মিরপুর-১০ কিংবা গাবতলী থেকে রিকশায় সহজেই যাওয়া যায় দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাট। এ ছাড়া সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা ট্যাক্সিক্যাবেও যাওয়া যায় সেই দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাট অথবা ট্রলার ঘাট। তারপর সেখান থেকে ট্রলার ২০ মিনিট পরপর ছেড়ে যায় সাদুল্লাহপুরের দিকে। জনপ্রতি ২৫ টাকা করে ভাড়া নেয়। স্পিডবোট, কোষা নৌকা, শ্যালো নৌকা চুক্তিতে ভাড়া নিয়েও যাওয়া যায় সাদুল্লাহপুর। সেক্ষেত্রে শুধু যেতে কোষা নৌকার ভাড়া ৩০০ টাকা, শ্যালো নৌকা ২৫০ টাকা, স্পিডবোট ৫০০-৬০০ টাকা। রুট-২ : টঙ্গী স্টেশন থেকে কামারপাড়া হয়ে সিএনজি নিয়ে বিরুলিয়া ব্রিজে যেতে হবে। ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা। বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে অটোতে ১০-১৫ টাকা ভাড়ায় আরকান বাজার, সেখান থেকে অটোতে ১০ টাকায় সাদুল্লাহপুর বা সরাসরি ২০ টাকায় বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে সাদুল্লাহপুর যাওয়া যায়। রুট-৩ : উত্তরা হাউজ বিল্ডিং, নর্থ টাওয়ার থেকে সোনারগাঁ জনপথ ধরে লেগুনাতে দিয়াবাড়ি যেতে হবে, তারপর একটু হেঁটে মেইন রোডে এসে, লোকাল গাড়িতে উঠে বিরুলিয়া ব্রিজ। বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে অটোতে ১০-১৫ টাকা ভাড়ায় আরকান বাজার, সেখান থেকে অটোতে ১০ টাকায় সাদুল্লাহপুর বা সরাসরি ২০ টাকায় বিরুলিয়া ব্রিজ থেকে সাদুল্লাহপুর যাওয়া যায়। আবার এখান থেকে নৌকা রিজার্ভ নিয়ে যাওয়া যায় সরাসরি সাদুল্লাহপুর। রিজার্ভ ভাড়া পড়বে ৫০০-৫৫০ টাকার মতো। ২৫ জনের মতো বসা যায়। সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রলার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কোথায় খাবেন : সাদুল্লাহপুর ট্রলার ঘাটের পাশেই অনেক খাবার হোটেল আছে। সেখানে আপনি সকালের নাশতা এবং দুপুরের খাবার সেরে নিতে পারবেন অথবা আপনি সঙ্গে করে খাবার নিয়েও যেতে পারেন। স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে ঘুরে আসুন গোলাপ গ্রাম। কথা দিচ্ছি মনের সব অবসাদ দূর হবে আর সুন্দর এই গ্রামটি আপনাকে জড়িয়ে নেবে এক অদ্ভুত মায়ায়।
×