ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অ্যালবাম ॥ কবিতার কাগজ, কবিদের কাগজ

প্রকাশিত: ০৭:২১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

অ্যালবাম ॥ কবিতার কাগজ, কবিদের কাগজ

বিগত বিয়াল্লিশ বছর ধরে কবিতা নিয়ে কাজ করছেন কবি মনজু রহমান। তাঁর কবিতার কাগজটির নাম ‘এ্যালবাম’। ‘এ্যালবাম’-এ লেখেননি এমন লেখকের সংখ্যা খুব কমই আছেন। কবি মনজু রহমান যে দরদ দিয়ে পত্রিকাটি করেন তা দেখলেই বোঝা যায়। কবিতার প্রতি তার মমত্ববোধ কতটা প্রগাঢ় তা পত্রিকাটি হাতে নিলে সহজেই আঁচ করা যায়। এ সংখ্যাটি অকাল প্রয়াত দীপক রঞ্জন চৌধুরীসহ মতিহারের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের- যাঁরা কবিতা-সাহিত্য ছোটকাগজ সম্পাদনায় মতিহার দ্যুতিময় করে গেছেন... তাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। এ সংখ্যায় স্মৃতিপর্ব : মতিহার পর্বে লিখেছেন, জামিল হায়দার- ‘ফিরে ফিরে যাওয়া’ শিরোনামে, কাজী মুস্তফা- ‘ছোটকাগজের ফুল কিংবা ঝরা বকুলের ঘ্রাণ’, আপেল আবদুল্লাহ- ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কবি মোশতাক দউদী’, মনিরা কায়েস- ‘স্মৃতিময় পালকের দিন’, তারিক-উল ইসলাম- ‘কুন্তলা-বৃত্তান্ত’, হাসনাত আমজাদ- ‘সেই সব দিন, ছিল রঙিন’, শহীদ ইকবাল- ‘নতুন টগবগে খুন’, মাহফুজুর রহমান আখন্দ- ‘প্রেমের ভেতর স্বপ্ন স্বপ্নের ভেতরে প্রেম’, প্রত্যয় হামিদ- ‘মতিহার : আমার কাব্যপ্রাণ’, মনজু রহমান- ‘আমি ও আমার চারণভূমি’ ও মাহমুদ হাসান- যে আমার আকাশছোঁয়া ভালোবাসা’ শিরোনামে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্মৃতির আঁকড় খুঁড়ে উজাড় করে লিখেছেন সেই সব ফেলে আসা সুখানুভূতিময় দিনগুলোর কথা। আসলে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের, সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিম-লের সেই উজ্জ্বল দিনগুলোকে কেউ সহজেই ভুলে যেতে পারে না। যেমন পারেননি এ সংখ্যার লেখকরা। তারই এক স্বাক্ষর প্রতিচ্ছবি চলতি সংখ্যা ‘এ্যালবাম’। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে মতিহারকে নিয়ে লেখকদের স্মৃতিময়, আনন্দ-বেদনার দিনগুলোকে ঝলমলে করে তুলেছেন। তাদের সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মৃতির সেলুলয়েডে ধরে রাখা অধ্যায়গুলো তুলে ধরেছেন। এখানে তারা কবিতা নিয়ে, সাহিত্য আড্ডা নিয়ে আর মধুর দিনগুলোতে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে জম্পেশ আড্ডা, জমকালো সেসব দিনের স্মৃতিকে যার যার মতো করে তুলে ধরেছেন স্মৃতিপর্বে। এর মধ্যেই কেউ কেউ জীবন থেকে হারিয়ে গেছেন। কেউবা লেখালেখির পাঠ চুকিয়ে ভিন্ন পথের দিশা হয়েছেন। মূলত স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে যে আনন্দ বেদনার কথামালা তারই এক উজ্জল প্রতিভাস হয়ে উঠে এসেছে ‘এ্যালবাম’-এর চলতি সংখ্যায়। মুক্তগদ্য পর্বে- ‘কবিতায় সঙ্গ-অনুষঙ্গ’ শিরোনামে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন- ‘বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ- কবিতা সৃষ্টি করে কবির বিবেক সান্ত¦¦না পায়, তার কল্পনা-মনীষা শান্তি বোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়। এর অর্থ সম্ভবত এ রকমই যে সৃষ্টির সঙ্গে কবির বিবেকের একটা তাড়না অনুভূত হয়, এই বিবেক তাড়িত হয় কবির কল্পনা মনীষার দ্বারা, আর এই কল্পনা মনীষা পাঠকের কল্পনাকে তৃপ্তি দেয় জীবনানন্দের ভাষা মতে, কবির কবিতা নিয়ে পাঠকেরও একটা কল্পনা বলয় তৈরি হতে পারে, যাকে বলা হচ্ছে ইমাজিনেশন।’ কবি অনেকভাবেই তার কবিতাকে মূর্ত করতে চান। তিনি কখনই অতিমানবিক হতে অথবা একেবারে পুরনোপন্থী তার মন সায় দেয় না। একটি সার্থক ও সৎ কবিতার জন্মের পশ্চাদে কবি নামক একজন শিল্পীর ধ্যাননিমগ্ন শিল্পীসত্তা-অনেকটাই তিনি যখন আত্মনিমগ্ন, নিঃসঙ্গ, আত্মকেন্দ্রে কুন্ডলীকৃত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কবিতার সঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রাণবন্ত আলোকপাত করেছেন। পাঠমুগ্ধ এ কবিতা বিষয়ক লেখাটি সকল পাঠককে মুগ্ধ করবে। অনেক ধন্যবাদ লেখককে এ ধরনের একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য। কৌশিক দাশগুপ্ত তার ‘বাংলা সাহিত্য কি ভেন্টিলেশনে চলে গেছে’ শিরোনামে মুক্তগদ্যে লিখেছেন- ‘কত মণিমাণিক্যই না লুকিয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের বুকে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের সময় বাদ দিলেও পরবর্তীতে তারা শঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ, রাজশেখর, শরবিন্দু, বিমল মিত্র, সমরেশ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বদ্ধুদেব বসু, নারায়ণ সন্যাল, পূর্ণেন্দু, ... আরও কত কত নাম একেবারে লাল সিঁদুরের মতো টকটক করছে বাঙালীর কপালে। এ নামগুলো সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। এদের পরে যারা লিখতে এসেছেন তারা আজ ষাটের কোঠায়, কিন্তু এই সম্ভ্রম আদায় করতে পারেননি।’ এমনিভাবে ‘বাংলা সাহিত্য কি ভেন্টিলেশনে চলে গেছে’ শিরোনামে তিনি একটি চমৎকার আলোচনা করেছেন। জয় গোস্বামী তার ‘প্রথম লেখা, প্রথম শেখা’ শিরোনামে লিখেছেন- ‘সেটা ১৯৭৫ সাল, কৃত্তিবাস-এ আমার কবিতা ছাপা হলো প্রথম। তখন বাড়ি বসে আছি পড়াশোনা ছেড়ে- মানে, সেই ১১ ক্লাস অবধি পড়াশোনা আমার। প্রতি বছরই কোমর বাঁধি, এবার ঠিক বসব ফাইনাল পরীক্ষায়- কোনবারই বসা হয় না। এরই মধ্যে কলকাতার একটা দুটো তিনটে লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হতে শুরু করেছে আমার কবিতা।’ এভাবেই কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘প্রথম লেখা, প্রথম শেখা’ নিয়ে অসাধারণ আলোকপাত করেছেন। জয় গোস্বামীর লেখাটা পাঠককে তাঁর লেখালেখি নিয়ে জানবার সুযোগ করে দেবে। ‘কবিতায় চিন্তাবৃত্তি : একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে বীরেন মুখার্জী লিখেছেন- ‘মানুষের সহজাত এক প্রক্রিয়া ‘চিন্তা’। স্বাভাবিক কোন মানুষ চিন্তাহীন থাকতে পারে না। চিন্তাশক্তিই পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করেছে। চিন্তা সতত পরিবর্তনশীল একটি উপলব্ধিও বটে। চরাচরের যে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় মানুষ চিন্তাক্লিষ্ট হয়। এটা চিন্তার প্রাথমিক স্তর। এ স্তরে মানুষ তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে না। কেননা, ঘটনা পরম্পরায় মানুষের চিন্তার স্তরগুলো দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।’ এভাবেই বীরেন মুখার্জী তার ‘কবিতায় চিন্তাবৃত্তি’ নিয়ে একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। পাঠককে এ লেখাটিও অনেক কিছু জানার পথ খুলে দেবে। এ সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন- খালিদ আহসান, হোসনে আরা হেনা, ইউসুফ তাপস, মনসুর আজিজ, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, নাজমুল হাসান, মাহমুদ কামাল, পারু পারভীন, আনোয়ার কামাল, অনু ইসলাম, হাসান ওয়াহিদ, প্রতীক ওমর, হাফিজ রশিদ খান, পাপড়ি মণি, আমির আযম খান, সোহেল মাহবুব, রাশেদ রহমান, মাহফুজ ফারুক, মাহবুবা করিম, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, আহমদ আজিজ, মামুন মোয়াজ্জেম, শফিকুল আলম শফিক, শাহানা সিরাজী, এসএম তিতুমীর, জেবুননেসা হেলেন ও এনাম আহমেদ। গ্রন্থালোচনা পর্বে শাহাদৎ সরকার লিখেছেন- ‘ডট বিন্দুর উত্তাপ : প্রেম ও রাজনীতির কাব্য’ শিরোনামে কবি মনজু রহমানের কবিতাগ্রন্থ নিয়ে। ‘ডট বিন্দুর উত্তাপ’ কবিতাগ্রন্থটি আমার আগেই পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। ধন্যবাদ শাহাদৎ সরকারকে অনবদ্য একটি আলোকপাত করার জন্য। অপরদিকে মোস্তফা হায়দার কবি জব্বার আল নাঈমের ‘এসেছি মিথ্যা বলতে’ কবিতাগ্রন্থ নিয়ে ‘সত বলার অন্যরূপ : কবি জব্বার আল নাঈম’ শিরোনামে চমৎকার একটি আলোচনা করেছেন। দুটি আলোচনা থেকেই পাঠক গ্রন্থ দুটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারবেন। ‘এ্যালবাম’ একটি অনিন্দ্য সুন্দর কবিতার কাগজ, আমাকে প্রতিটি লেখাই মুগ্ধ করেছে। আমি বলতে গেলে এ পত্রিকাটির একজন নিয়মিত লেখক-পাঠক-সংগ্রাহক। বিগত বিয়াল্লিশ বছর ধরে মানসম্পন্নভাবে একটি কবিতার কাগজকে টিকিয়ে রাখা যে কী অপরিসীম মেধা-ধৈর্য ধারণ করতে হয়, তা কেবলমাত্র যিনি কাজটি করেন, তিনিই বুঝেন। পত্রিকাটির অঙ্গসঙ্গা নান্দনিক, পাতায় পাতায় রয়েছে কারুকার্যময় কাজ। পত্রিকাটি তার মান ধরে রাখতে পেরেছে বলে সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই। পত্রিকাটির ব্যাপক প্রচার, পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্য প্রত্যাশা করছি। পত্রিকাটি সামনে এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে।
×